সংবাদ প্রকাশের জের, হবিগঞ্জে ‘মঞ্জুরী ভবনে’ যুবলীগ-ছাত্রলীগের হামলা

সময়: 10:49 pm - April 21, 2021 | | পঠিত হয়েছে: 148 বার

অমূল্য দাশ একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থে শখ করে হবিগঞ্জ শহরে বানিয়েছিলেন একটি বাসা। স্ত্রীর নামে বাড়ির নাম রেখেছেন ‘মঞ্জুরী ভবন’। মেয়ের জামাইয়ের ওপর ক্ষোভের জের ধরে একদল উচ্ছৃঙ্খল যুবকের আক্রমণে ৩ তলা ভবনটি এখন ধ্বংসস্তূপ।

অমূল্য দাশের স্ত্রী মঞ্জুরী দাশ পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপক। এই দম্পতির দুই কন্যা। দুজনই লন্ডনপ্রবাসী। শেষ বয়সে স্বামী-স্ত্রী শান্তিতে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গত সোমবার সবকিছু তছনছ হওয়ায় সাবেক অডিটর অমূল্য দাশ অনেকটা বাকরুদ্ধ। স্ত্রী মঞ্জুরী দাশ মাসখানেক আগে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী। চোখের সামনে বাসার দরজা জানালা আসবাবপত্র ভাঙচুর, লুঠপাট হলেও কেবল তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার শক্তিই ছিল না তার।

এদিকে ভবনটির অন্যান্য ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়ারা সর্বস্ব হারিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন কেউ কেউ। তাদের চোখে মুখে এখনো অজানা ভীতি। নিরাপত্তার জন্য এখন সেখানে পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রোববার শাহ আরজু নামে এক ব্যক্তি ফেইসবুকে দৈনিক আমার হবিগঞ্জ এর বিরুদ্ধে সোমবার বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেন। ঘটনার দিন বেলা ১২টার দিকে শহরের চিড়াকান্দি ও আশপাশ এলাকা ঘিরে রাখে প্রায় দুই তিন শ যুবক। এলাকাটিতে অধিকাংশই হিন্দু পরিবারের বসবাস। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে প্রায় ১শ বাসা বাড়িতে। পুলিশ নিরাপত্তার জন্য ঘটনাস্থলে অবস্থান নেয়।

দুপুর একটার দিকে সমবেত যুবকেরা প্রথমেই পত্রিকার অফিস লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। দফায় দফায় ইটপাটকেল নিক্ষেপের একপর্যায়ে পুলিশের বেষ্টনী ভেঙে এরা পত্রিকার অফিসের পাশে থাকা  ‘মঞ্জুরী ভবনে’ হামলা চালায়। হামলাকারীরা কলাপসিবল গেট ও  ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে প্রবেশ করে চালায় ভাঙচুর ও লুটপাট। ভয়ভীতি দেখিয়ে নারীদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নেয় স্বর্ণালংকার। তালা ভেঙে আলমারি থেকে টাকা-পয়সা, দামি জিনিসপত্র লুটে নেয়। এ সময় হামলাকারীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে সুশান্ত দাশ গুপ্ত ,তার ভাগনে হরি, শুভ  আহত হন। ভবনটি দৈনিক আমার হবিগঞ্জ সম্পাদক সুশান্ত দাশ গুপ্তের শ্বশুরের বাসা।

পুলিশ এ সময় ১১ রাউন্ড টিয়ার গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে লন্ডভন্ড হয়ে যায় বাসার পানির ট্যাংক, ফুল বাগান  থেকে শুরু করে সবকিছু। আতঙ্কিত নারী-পুরুষদের চিৎকারে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে। পরবর্তীতে  র‌্যাব ও বিজিবি ঘটনাস্থলে পৌঁছালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

বাসার ভাড়াটিয়া পঙ্কজ দেব রায় বলেন, বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়েছে বাসাকে লক্ষ্য করে। পুলিশ থাকার পরেও এরা বিল্ডিংয়ে ঢুকে যে যেভাবে পারে জিনিসপত্র লুটে নিয়েছে। হবিগঞ্জে এ ধরনের ঘটনা কখনো ঘটেছে বলে মনে হয় না। লকডাউনের কারণে বাসায় ছিলাম। নইলে আমার বউ বাচ্চাদের কি হতো ভগবানই জানেন।

দৈনিক আমার হবিগঞ্জ সম্পাদক সুশান্ত দাশ গুপ্ত অভিযোগ করেন, জেলা আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতার নির্দেশে পৌর মেয়র ও জেলা যুবলীগের সভাপতি আতাউর রহমান সেলিমের উপস্থিতিতে যুবলীগ, ছাত্রলীগের কিছু কর্মী এই ঘটনা ঘটিয়েছে।

তিনি বলেন, ওই দুই নেতাসহ কয়েকজন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন। সোমবারের ঘটনার মধ্য দিয়ে তারা প্রতিশোধ চরিতার্থ করেছেন। তাদের প্রত্যক্ষ মদদে এর আগে একাধিকবার পত্রিকা বন্ধের জন্য মিছিল, মানববন্ধন করাসহ জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। সাংসদ আবু জাহিরের দুর্নীতির খবর প্রকাশ করায় গত বছর ডিজিটাল আইনে ৩ সহকর্মীসহ আমার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। আমাদেরকে বেশ কিছুদিন জেলে থাকতে হয়েছে।

তিনি বলেন, সোমবার রাতে পত্রিকা না ছাপার জন্য ১০/১৫টি মোটরসাইকেলে কিছু যুবককে দিয়ে প্রেসের কর্মচারীকে মারধর ও প্রেস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার হুমকি দেয়া হয়েছে । এমতাবস্থায় মঙ্গল ও বুধবারের সংখ্যা জেলা সদরের বাইরে থেকে ছাপাতে হয়েছে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে হবিগঞ্জের নবনির্বাচিত মেয়র ও জেলা যুবলীগের সভাপতি আতাউর রহমান সেলিম বলেন, পত্রিকায় হবিগঞ্জের বিশিষ্টজনদের বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করছে। এর জের ধরেই এই ঘটনাটি ঘটেছে বলে ধারণা করি। জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমার দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাই  ঘটনাস্থলে গিয়ে সংঘর্ষ থামানোর চেষ্টা করি। হ্যান্ডমাইক দিয়ে আমি রমজান মাসের দোহাই দিয়ে দু’পক্ষকে থামাতে চেষ্টা করি। বিক্ষুব্ধ যুবলীগ ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের সেখান থেকে ফিরিয়ে না আনলে খুনখারাবি হয়ে যেতো।

হবিগঞ্জ থানার ওসি মাসুক আলী পত্রিকার বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংবাদকে কেন্দ্র করে এই হামলা হয়েছে বলে জানান। পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্লা জানান, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে হামলাকারীরা পাশের একটি ভবনের ছাদে দিয়ে মঞ্জুরী ভবনে ঢুকে পড়ে। ঘটনার তদন্ত চলছে। এখনো মামলা হয়নি। এই ঘটনায় পুলিশ আহত হওয়ায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।

ঘটনার পর দিন মঙ্গলবার জেলা প্রশাসক ইসরাত জাহান, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্লাসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ক্ষতিগ্রস্ত মঞ্জুরী ভবনে পরিদর্শনে যান। এ সময় তাদের সাথে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোতাচ্ছিরুল ইসলাম, সাবেক পৌর মেয়র মিজানুর রহমান, আওয়ামী লীগ নেতা অনুপ কুমার দেব মনা, মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সামছু মিয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। তারা ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সমমর্মিতা প্রকাশ করেন। দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে জানান জেলা প্রশাসক।

এদিকে বাসাবাড়িতে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ (মার্কসবাদী), গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতি, উদীচী। মঙ্গলবার ওই সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ হামলার শিকার বাসভবনটি পরিদর্শন করেন। তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। অবিলম্বে হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান।

সুশাসনের জন্য নাগরিক ও বিশিষ্ট হিন্দু কমিউনিটি নেতা অ্যাডভোকেট ত্রিলোক কান্তি চৌধুরী বিজন বলেন, হিন্দুদের বাসাবাড়িতে এত বড় সন্ত্রাসী হামলা হয়ে গেল এর প্রতিবাদে এখন পর্যন্ত হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান পরিষদ, পূজা উদ্‌যাপন কমিটির মতো সংগঠনগুলো মানববন্ধন, মিছিল তো দূরের কথা, একটি বিবৃতি দিতেও সাহস করেনি।

রাজশাহী বার্তা/admin

এই বিভাগের আরও খবর