নাটোরের ওষুধি গ্রামে বাজার হারানো কৃষকের দুর্দিন

সময়: 12:23 pm - June 18, 2020 | | পঠিত হয়েছে: 404 বার

দেশের একমাত্র ওষুধি গ্রাম খ্যাত নাটোরের লক্ষ্মীপুর-খোলাবাড়িয়ায় বছরে ছয়শ’ কোটি টাকা মূল্যমানের প্রায় সাড়ে আঠারো হাজার টন এ্যালোভেরা উৎপাদন হচ্ছে। প্রায় দুই হাজার টন করে শিমুলমূল, অশ্বগন্ধাসহ বিভিন্ন প্রজাতির উৎপাদিত মোট ভেষজের বাৎসরিক বাজার মূল্য প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। করোনা পরিস্থিতি ছাড়াও উৎপাদক থেকে ক্রেতার মাঝে সিন্ডিকেটের নিত্য অবস্থান থাকায় কৃষকরা এ্যালোভেরাসহ অন্যান্য ভেষজের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে কৃষি বিভাগ ও প্রশাসন কৃষকদের স্বার্থে কার্যকরী ভূমিকা রাখার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছে।

১৯৯৫ সালের দিকে এলাকার আফাজ পাগলা তাঁর কবিরাজী কাজে ব্যবহারের জন্য স্বউদ্যোগে ভেষজ উদ্ভিদের চাষাবাদ শুরু করেন। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে ছবির মত সুন্দর একই সমতলে থাকা পুরো গ্রামে। শেষে সারা ইউনিয়ন জুড়ে। শুধু আবাদি জমিই নয় গ্রামের প্রতিটি বাড়ির আনাচে-কানাচে, বেড়া ও রাস্তার ধারে চোখে পড়ে ভেষজ উদ্ভিদের রকমারী গাছ। তবে সব সৌন্দর্য ছাড়িয়ে এ্যালোভেরা গাছ সবচেয়ে দৃষ্টি নন্দন।

নাটোর সদর উপজেলা কৃষি অফিসের হিসাবে লক্ষ্মীপুর-খোলাবাড়িয়াতে ১৪০ প্রকার ভেষজ উদ্ভিদ জন্মে। এর মধ্যে এ্যালোভেরা ছাড়াও শিমুল মূল, অশ্বগন্ধা, মিশ্রি দানা ও শতমূল প্রসিদ্ধ। ভেষজ উদ্ভিদের মোট ১৪০ হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে ৬৫ হেক্টরে ঘৃত কুমারী বা এ্যালোভেরা চাষ হচ্ছে। সাড়ে চার হাজার কৃষক ভেষজ উদ্ভিদ চাষ করছেন।

মূলত: ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ১ বিঘা জমিতে এ্যালোভেরার ১২ হাজার চারা রোপণ করা যায়। সেচের ব্যবস্থা রেখে সারিবদ্ধ এসব গাছ থেকে রোপণের ৩ মাস পর থেকে পাতা সংগ্রহ শুরু হয়। চাষাবাদ, পরিচর্যা ও সেচের কাজে সারা বছর জমিতে ১০০ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। জৈব সার ছাড়াও পরিমাণমত ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, দস্তা ও বোরিক এসিড প্রয়োজন হয়। পাতার কালো দাগ পড়া রোধে ব্যবহার হয় চুন। তবে চুনের বিকল্প হিসেবে সম্প্রতি কৃষকরা ঝরণা পদ্ধতির সেচ ব্যবহার করছেন। পাতা ছিদ্রকারী মশাসহ অন্যান্য কীটপতঙ্গ দমনে সম্প্রতি ছত্রাক নাশক টাইকোডার্মা ও সেক্স ফেরোমেন ব্যবহারে সম্প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে কৃষি বিভাগ ও কৃষকরা। লক্ষ টাকা খরচ করে বছরে ১ বিঘা জমি থেকে খরচ বাদে লক্ষাধিক টাকার মুনাফা অর্জন সম্ভব। বিঘাপ্রতি এ্যালোভেরার গড় উৎপাদন ৩০ টন।

ভেষজ উদ্ভিদ শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তৈরি করা হচ্ছে নানা রকম ভেষজ ওষুধ। এর বিপণন কাজ চলছে এলাকার ৪টি স্থানে গড়ে ওঠা প্রায় ৫০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। তবে এ্যালোভেরা প্রক্রিয়াজাতকরণের কোন উপায় এলাকাতে নেই। পাতা সংগ্রহ করে দ্রুতই পাঠাতে হয় গন্তব্যে। আর এ গন্তব্য ওষুধ ও প্রসাধন শিল্পে, জুস তৈরিতে এবং শরবতে। হামদর্দ ও ২/১টি ওষুধ কোম্পানী এ্যালোভেরার পাতা ক্রয় করে থাকে। ময়মনসিংহের ভালুকাতে স্থাপিত রপ্তানিমুখী জুস তৈরিকারক বিদেশী মালিকানাধীন তাইওয়ান সিন লিন এন্টারপ্রাইজ এ্যালোভেরার বড় ক্রেতা। এছাড়া প্রতিদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক ট্রাক বোঝাই এ্যালোভেরা গেলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে এখন তা একেবারেই বন্ধ বলা চলে। মাঠের পর মাঠ জমিতে এ্যালোভেরার পাতা সংগ্রহ না করায় পাতার ওজন বেড়ে মাটিতেই পড়ে থাকছে, আবার আগাছায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে এ্যালোভেরার জমি। নিড়ানি বা পাতা সংগ্রহে আগ্রহ না থাকার কারন সম্পর্কে কৃষকরা জানান- চাষের খরচই ওঠেনি, কেন আর বাড়তি খরচ করি?

এ্যালোভেরার পাতা সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় নিরুপায় উৎপাদনকারী কৃষক থেকে ক্রেতা পর্যন্ত বিপণন কাজে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। খোলাবাড়িয়া ওষুধী গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মোঃ জয়নাল আবেদিন বলেন, কৃষকরা ৩০০ কেজির এ্যালোভেরা বাসকেট তাইওয়ান কোম্পানীর লোকজনের কাছে বিক্রি করছে ৫০০ টাকায়। অর্থাৎ কেজিতে কৃষক পাচ্ছে দেড় টাকার কিছু বেশী। অথচ কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যান তথ্যে দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ টাকা। আর শরবতের বিক্রেতাদের কাছে এ্যালোভেরা বিক্রি করে কৃষকরা কিছুটা লাভবান হলেও এই কার্যক্রম করোনা পরিস্থিতির কারণে একেবারে বন্ধ। একই কারনে প্রসাধনী আর ওষুধ শিল্পে সরবরাহও ব্যাপকভাবে কমেছে।

এলাকার কৃষকদের জন্যে কৃষি বিভাগ প্রশিক্ষণের আয়োজন করে থাকে। সমবায় বিভাগও এলাকার কৃষকদের নিয়ে গঠিত সমবায় সমিতির সদস্যদের জন্যে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে এলাকায় কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি এবং অনুদান ও ঋণ সরবরাহ করে যাচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান উত্তরা ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম সোসাইটি। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এলাকার ২০টি নার্সারির প্রত্যেকটিকে ২৫ হাজার টাকা এবং ১০০ কৃষকের প্রদর্শনী খামার তৈরী বাবদ চার হাজার টাকা করে অনুদান দেয়া হয়েছে বলে জানান বিজিনেস ডেভেলপমেন্ট অফিসার এম এ সেলিম। বর্তমানের মন্দাদশা সম্পর্কে এম এ সেলিম বলেন, করোনাকালীন সময়ে ভেষজ চাষীরা প্রতিদিন ১৫ লাখ টাকার ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।

কৃষকদের স্বার্থ উপেক্ষা করে একটি সিন্ডিকেট সকল কৃষকদের কাছ থেকে নামমাত্র দরে এ্যালোভেরা ক্রয় করে ১৩ থেকে ১৪ টাকা কেজি দরে সরবরাহ করে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে ঢাকা সহ অন্যান্য স্থানে আড়তের মাধ্যমে প্রতিদিন ছয় থেকে সাত ট্রাক এ্যালোভেরা পাঠাতেও অতীতে সিন্ডিকেট সক্রিয় ছিল। তবে এই কার্যক্রম এখন পুরোটাই বন্ধ।

অর্জুনপুর এলাকায় ৫বিঘা জমিতে এ্যালোভেরা চাষ কারী আদর্শ কৃষক আলফাজুল আলম সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এ্যালোভেরার মূল্য হ্রাস কারসাজির অভিনব প্রতিবাদ করেছিলেন দু’বছর আগে। তিনি এ্যালোভেরার কয়েক মণ পাতা অল্প দরে বিক্রি না করে জমির পাশের গর্তে রেখে জৈব সার তৈরি করেন। আলফাজুল আলম বলেন, সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে প্রশাসনিক কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এছাড়া জুস তৈরিকারী কোম্পানী ও প্রসাধন সামগ্রীর তৈরিকারী কোম্পানী স্থানীয় বাজার থেকে এ্যালোভেরা ক্রয় করার পদক্ষেপ গ্রহণ করলে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরির মাধ্যমে কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ হতে পারে।

ভেষজ উৎপাদনকারী আদর্শ কৃষক মোঃ শহিদুল ইসলাম, সমবায় নেতা ও কবিরাজ মোঃ জয়নাল আবেদিনসহ অন্যান্য সচেতন কৃষকবৃন্দ ভেষজ চাষীদের দুূর্দিন ঘুচিয়ে অবস্থার উত্তরণে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। এরমধ্যে প্রশাসনিক উদ্যোগে সিন্ডিকেট ভাঙা, এ্যালোভেরা সংরক্ষণে একটি হিমাগার নির্মাণ, সাবান-শ্যাম্পুসহ প্রসাধনী তৈরীর কারখানা নির্মাণে উদ্যোক্তা খুঁজে বের করা, আধুনিক কৃষি উপকরণ সরবরাহ এবং করোনাকালীন বিশেষ ঋণ সহায়তা প্রদান উল্লেখযোগ্য। ভেষজ উৎপাদন ও বিপনন দেখভাল করতে শুধুমাত্র এই দায়িত্বে কৃষি বিভাগ একজন কর্মকর্তা নিয়োজিত করতে পারে।

নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক সুব্রত কুমার সরকার জানান, করোনা সংকট উত্তরণে সরকার কৃষকদের জন্যে সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। মাত্র চার শতাংশ সার্ভিস চার্জের এই প্যাকেজ ঋণ ভেষজ চাষীদের প্রদানে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নাটোরের জেলা প্রশাসক মোঃ শাহরিয়াজ ভেষজ গ্রামকে নাটোরের ঐতিহ্য হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণে সব রকমের প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। নাটোরের এই ঐতিহ্যকে বাঁচতেই হবে, বাঁচাতে হবে সংশ্লিষ্ট কৃষকবৃন্দকে।

রাজশাহী বার্তা/admin

এই বিভাগের আরও খবর