জয়পুরহাটের আক্কেলপুরের মুংলীর সংগ্রামী জীবন, ভ্যানের চাকায় ঘুরছে সংসার
কারো কাছে হাত না পেতে নিজের পায়ে চলার জন্য ভ্যান বেছে নিয়েছেন জয়পুরহাটের সপ্তমী রানী মুংলী। ভ্যানের চাকায় ঘুরছে তার সংসার। ভ্যান চালিয়ে তিন সন্তানসহ বাবা-মায়ের ভরণ-পোষণ চালান জেলার আক্কেলপুর উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের।
সপ্তমী রানী মুংলী বলেন, ২০০২ সালে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বামনগ্রামের কাশীনাথের বেকার ছেলে বিটল মালীর সঙ্গে চায়না ফনিক্স বাইসাইকেল, আধা ভরি সোনা, ২০ হাজার টাকা ও ঘর সাজানোর আসবাবপত্র দিয়ে খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। সেই সংসারে অভাব যেমন ছিল তেমনি ছিল স্বামীর নির্যাতন।
সংসার কি জিনিস তখন তা ঠিক মতো না বুঝতেই বিয়ের পর থেকে শুরু হয় শ্বশুর বাড়ির অমানবিক নির্যাতন। নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন মুংলী। একে একে বলতে থাকেন তাকে কিভাবে তার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা নির্যাতন করতো।
মুংলী বলেন, প্রথমে শ্বশুর আমাকে মারধর করতো। তারপর স্বামী বিটল বাবার পক্ষ নিয়ে আমাকে কখনো চড় থাপ্পর, আবার কখনো লাঠি দিয়ে পেটাতো। প্রতিবাদ করলে বা জোড়ে কাঁদলে মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে সিগারেট না হয় জ্বলন্ত মশার কয়েলের স্যাঁকা দিতো। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বাবার বাড়ি আসলে অভাবী বাবা মা আবারো জোর করে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিতো। তারপর দুইগুণ, তিনগুণ নির্যাতন।
মুংলীর মা শেফালী রানী বলেন, এভাবে শত নির্যাতন সহ্য করে কখনো শ্বশুর বাড়ি আবার কখনো বাবার বাড়ি আসা যাওয়ার মধ্যেই তিনটি সন্তানের জন্ম দেন মুংলী। সন্তানদের কথা ভেবে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে বলে মুংলীকে স্বামীর বাড়িতে বার বার পাঠানো হলেও সুখী হয়নি মুংলী।
নির্যাতনের মাত্রা এত বেড়ে গেল, স্বামীর নির্যাতন সইতে না পেরে ২০১৩ সালে তিন সন্তানকে নিয়ে একেবারে চলে যান হত দরিদ্র বাবার বাড়িতে।
এলাকাবাসী জানান, বাবার অভাবের সংসারে বোঝা হতে চাননি সংগ্রামী নারী মুংলী। দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড় করতে ও তিন সন্তানকে মানুষ করতে শুরুর দিকে পাড়ায় পাড়ায় পান ফেরি করতেন। এতেও তার সংসারে টলমল অবস্থা। যেন নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থা। কিন্তু তাতেও হাল ছেড়ে না দিয়ে একটু বেশি আয়ের জন্য মুংলী ২০১৫ সালে শক্ত-সামর্থ পুরুষদের পেশা বলে পরিচিত ভ্যান চালাতে শুরু করেন।
ভ্যান চালাতে আগের চেয়ে অনেক কষ্ট কম হয় জানিয়ে মুংলী বলেন, আগে পা প্যাডেল ঘুরিয়ে ভ্যান চালাতাম আর এখন ব্যাটারি চালিত ভ্যান চালাই, প্রতিদিন সকালে ভ্যান নিয়ে বাড়ি থেকে বের হই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভ্যান চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরি। হাত-পা তখন প্রচণ্ড ব্যথা করে। দিনে দুই-তিনশ’ টাকা কামাই করে বাড়ি ফিরি। সেই টাকা দিয়ে সংসারের খরচ চালাই ও তিনটা ছেলে মেয়েকে পড়াশুনা করাই।
১২ বছর বয়সী বড় ছেলে তৃতীয়, মেঝ মেয়ে সুফলা দ্বিতীয় শ্রেণিতে ও ৭ বছরের ছোট মেয়ে শংকরীকে মানুষের মতো মানুষ করার স্বপ্ন দেখেন মুংলী।
মুংলী বলেন, পুরুষ ভ্যান চালকরা সবাই তাকে ছোট করে দেখেন না। কোনো কটুক্তি করেন না বা খারাপ কোনো আচরণও করেন না। সবাই তাকে ভালোবাসেন।
ভ্যান চালক একই এলাকার বামনী গ্রামের ইয়াকুব আলী, পার্শ্ববর্তী নূর নগর গ্রামের মোস্তফাসহ এলাকাবাসী জানান, তারা মুংলীর সব কিছুই জানেন। মুংলীর যাতে একটু বেশি টাকা রোজগার হয় সে জন্য তারা তাকে ২/৪ জন যাত্রী বা বহনের জন্য মালামাল ছাড় দেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিলকপুর ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম মাহবুব সেলিম বলেন, মুংলীর বসত বাড়ি নেই। তাই প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে আবাসন প্রকল্পের একটি বাড়ি তৈরি করে দেয়ার জন্য তার নামের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। মুংলীদের পাশে থাকার জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনসহ বিত্তবানদের কাছে আহবান জানান এই জনপ্রতিনিধি