জমে উঠেছে দেশের বৃহৎ কানসাট আম বাজার
ফলের রাজা আম। আর আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জ।চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার প্রধান অর্থকরী ফসল আম। তবে কেবল নামেই কি আমের রাজধানী? মোটেও নয়। দর্শন, গুণ ও ফলেই পরিচয়। তাইতো বছর ঘুরে চির চেনা রূপ নিয়ে ফিরেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সর্বত্রই এখন আম আর আম।
তবে এবছর ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে আম ও লিচুর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।এবার উৎপাদন কম, তাই আমের দাম কিছুটা বেশি।
হাটে-মাঠে, পথে-প্রান্তরে, বাগানে-বাগানে, পাড়ার অলিগলিতে এখন শুধুই আমের হাঁক-ডাক। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন সড়ক ও মোহনাগুলো এখন কাঁচা-পাকা আমে ছেয়ে গেছে।চাঁপাইনবাবগঞ্জের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার “কানসাট আম বাজার“।খানে রয়েছে ছোট বড় প্রায় ২৫০টি আমের আড়ত।এ বাজারে বড় বড় ঝুড়ি ও প্লাস্টিকের খাঁচা বোঝাই করে আম আসে আশপাশের এলাকার নতুন-পুরোনো বাগান থেকে।তাই চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাতাসে এখন আমের মৌ-মৌ সৌরভ ভেসে বেড়াচ্ছে। তবে ঘর্ণিঝড় আম্পান, তাপদাহ ও শিলাবৃষ্টিতে এ বছর কমেছে আমের ফলন, বেড়েছে দাম।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্বাদের আমে এখনও লোভের থাবা বসাতে পারেনি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তাই অপরিপক্ক আমে কেমিক্যালের মিশ্রণ নয়, বেঁধে দেওয়া সময়েরও পরেই পরিপক্ক আম ভাঙা হচ্ছে গাছ থেকে। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে হাট-বাজার শেষ তাবুও পাওয়া যাচ্ছে গোপালভোগ ও মোহনভোগ। আর কয়েকদিন পর পাওয়া যাবে ক্ষিরসাপাত, ল্যাংড়া, আম্রপালি, ক্ষীরভোগ, মোহনভোগ, রাজভোগ, রানিভোগ, রানিপছন্দ, সিন্দুরা, সুবর্ণরেখা, কুয়াপাহাড়ি, নাকফজলি, ফজলি, চিনি ফজলি, সুরমাই ফজলি, চিনি মিসরি, জগৎমোহিনী, রাখালভোগ, রাঙাগুড়ি, গোবিন্দভোগ, তোতাপুরী, মিশ্রিকান্ত, জালিবান্ধা, বোম্বাই, ভুতো বোম্বাই, পাহাড়িয়া, গোলাপখাস, কাকাতুয়া, দাদভোগ, চম্পা, সূর্যপুরী, কাঁচামিঠা, কলামোচা, শীতলপাটি, লক্ষ্মণভোগ, গোলাপবাস, কিষানভোগ বান্দিগুড়ি, রাংগোয়াই, আশ্বিনা, ভাদুরিগুটি, বনখাসা, বউ ফুসলানি, ক্ষীরমণ, দুধসর, রঙভিলা, পারিজা, আনোয়ারা, দিলশাদ, আম্রপালি, মল্লিকা, বেগমবাহার, পূজারীভোগ, পলকপুরী, রাজলক্ষ্মী, দুধকুমারীসহ নানান জাতের বাহারি নামের স্বাদের আম।
বিরামহীন বেচাকেনা চলছে প্রাচীন এই জনপদে। চাঁপাইনবাবগঞ্জজুড়ে এখন কেবল আমেরই রাজত্ব। বাগানে বাগানে চলছে গাছ থেকে আম ভাঙার কাজ। এতে শেষ মুহূর্তে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে ব্যবসা।
কেবল হাট-বাজার নয়, আম কেন্দ্রীক ব্যবসা-বাণিজ্য পাল্টে দিয়েছে এ অঞ্চলের গ্রামীণ জনপদের অর্থনীতিও। রাজশাহী অঞ্চলের দুইটি বড় আমের মোকাম রাজশাহীর বানেশ্বর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে প্রতিদিন বেচাকেনা হচ্ছে কোটি টাকার আম। আমের কারবার নিয়ে রাজশাহী অঞ্চলের প্রায় ২০ হাজার মানুষের মৌসুমি কর্মসংস্থানও হয়েছে। মধুমাস জ্যৈষ্ঠের পরও পুরো জুন-জুলাই মাসের মাঝামাঝি পযর্ন্ত চলবে ‘আম বাণিজ্য’। তাই আম বাগানের শ্রমিক ও আমের ঝুড়ি বানানোসহ নানা সহায়ক কাজে নিয়োজিত লোকজনের কর্মসংস্থানে উত্তরের এ জনপদ কর্মব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
এবছরও রোজার মধ্যে শুরু হয় আমের মৌসুম। তবে তখন ব্যাপকভাবে আম না ভাঙায় ঈদের পর জমে ওঠে কানসাট আম বাজার। এখন বাজারে রয়েছে ক্ষিরসাপাত (হিমসাগর) ও ল্যাংড়া জাতের আম। সঙ্গে রয়েছে লক্ষণভোগসহ নতুন নতুন জাতের গুটি আম। দাম চড়া হলেও আমের বেচাকেনা বেড়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সবচেয়ে বড় আমের মোকাম শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট আম বাজারে সরেজমিনে দেখা যায়, গোপালভোগ আম বেশি পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষিরসাপাত বা হিমসাগর আমও রয়েছে। আর চলতি সপ্তাহে বেশি উঠেছে ল্যাংড়া জাতের আম। রয়েছে লক্ষণভোগও। চাষিরা গাছ থেকে আম নামিয়ে ঝুড়ি বা প্লাস্টিকের খাঁচায় করে এ আম হাটে আনছেন। দর-দামের পর ঝুড়িসহ তা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেটসহ দূর-দুরান্ত থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ীরা। দিন-রাত সমানতালে চলছে আমের কারবার। এবার ফলন কম হলেও দাম বেশি পাওয়ায় আম চাষি ও ব্যবসায়ীরা খুশি।
কানসার্ট বাজারের আম এক ব্যবসায়ী রাজশাহী বার্তাকে জানান, রোববার বাজারে হিমসাগর আম প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার থকে ২৪শ’ টাকায়। গুটি আমের দাম ১২শ’ থেকে ১৫শ’ টাকা মণ।লখনা বিক্রি হচ্ছে ৮শ’ টাকা মণ, ল্যাংড়া ১৮শ’ থেকে ২ হাজার টাকা এবং গুটি আম ৬শ’ থেকে ১২শ’ টাকা মণ।এবার বাগানগুলোতে আম কম থাকায় দাম বেশি বলছেন ব্যবসায়ীরা। তবে ভালো দাম পেয়ে খুশি ব্যবসায়ী ও আমচাষিরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক নজরুল ইসলাম রাজশাহী বার্তাকে জানান, চলতি মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জে লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন আমের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।জেলায় ৩৩ হাজার ৩৫ হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে।ফলন কমের কারণে শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হলেও কোনো সমস্যা হবে না।যে ফলন হবে তা দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ সারাদেশে আমের চাহিদা পূরণ সম্ভব বলেও করেন কৃষি বিভাগের এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।তবে আগামী ১৩ জুন থেকে ডাকবিভাগের ট্রাকে বিনা ভাড়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম ঢাকায় যাবে। এছাড়া শুক্রবার থেকে স্পেশাল ম্যাঙ্গো ট্রেনে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম ঢাকায় পৌঁছানো হচ্ছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) এজেডএম নূরুল হক রাজশাহী বার্তাকে বলেন, জেলা প্রশাসনের বেধে দেওয়া সময় অনুযায়ী আম চাষি ও ব্যবসায়ীরা আম ভাঙতে এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যার মুখে পড়েননি। অনেকে নির্ধারিত সময়ের পরে আম ভাঙছেন। তাই চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম ভেজাল ও কেমিক্যাল মুক্ত, পরিপক্ক এবং নিরাপদ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
রাজশাহী বার্তা/admin