শীত আসছে, চলছে রস সংগ্রহের প্রস্তুতি
কিছু দিন যাবত রাতের শেষে কুয়াশা জানান দিচ্ছে, শীত আসছে। প্রতিবছর শীতকালে গ্রাম-বাংলায় খেজুর রস দিয়ে গুড় তৈরি হয়। তাই নওগাঁর আত্রাই উপজেলার প্রতিটি গ্রামে গ্রামে খেজুর রস সংগ্রহের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গাছিরা খেজুর গাছ কাটার কাজে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই গাছ থেকে রস সংগ্রহের পর্ব শুরু হবে।
এরপর এসব রস থেকে লালি ও গুড় তৈরির পর্ব শুরু হয়ে চলবে প্রায় মাঘ মাস পর্যন্ত। যত বেশি শীত পড়ে তত বেশি মিষ্টি রস দেয় খেজুর গাছ। এ গাছ ৮ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত রস দেয়। শীতের পুরো মৌসুমে চলে রস, গুড়, পিঠা, পুলি ও পায়েস খাওয়ার পালা। এছাড়া খেজুরের পাতা দিয়ে আর্কষনীয় ও মজবুত পাটি তৈরি হয়। এমনকি জ্বালানি কাজেও ব্যাপক ব্যবহার। কিন্তু জয়বায়ু পরিবর্তন, কালের বির্বতনসহ বন বিভাগের নজরদারি না থাকায় বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ এখন উপজেলা জুড়ে বিলুপ্তির পথে।
খেজুর রস ও গুড়ের জন্য আত্রাই উপজেলার এক সময় খ্যাতি ছিল। এখনও শীতকালে শহর থেকে মানুষ দলে দলে গ্রামে ছুটে যায় খেজুর রস খেতে।
তবে সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম-বাংলার প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী খেজুরের গুড়। কিছুদিন আগেও বিভিন্ন এলাকার অধিকাংশ বাড়িতে, ক্ষেতের আইলে, ঝোপ-ঝাড়ের পাশে ও রাস্তার দুই ধার দিয়ে ছিল অসংখ্য খেজুর গাছ। অনেকটা প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠেছিল এসব গাছ। প্রতিটি পরিবারের চাহিদা পূরণ করে অতিরিক্ত রস দিয়ে তৈরি করা হতো সুস্বাদু খেজুরের গুড়। সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবে এসব খেজুর গাছ এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। এসব গাছ ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে বেশি ব্যবহার হয়। তাই দিনদিন খেজুর গাছ কমছেই।
এক সময় সন্ধ্যায় গ্রামীণ পরিবেশটা খেজুর রসে মধুর হয়ে উঠতো। রস আহরণকারী গাছিদের প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যেত সে সময়। রস জ্বালিয়ে পাতলা ঝোলা, দানা গুড় ও পাটালী তৈরি করতেন গ্রামের মানুষ।
নাটোরের লালপুর উপজেলা থেকে আসা গাছি কালাম মিঞা ও তার সহকর্মীরা বলেন, ‘আমরা পেশাগত কারণে প্রায় প্রতি বছরেই আত্রাই উপজেলার বজ্রপুর গ্রামের আব্দুল কুদ্দুসের জমিতে তাবু গেড়ে বসি। ওই এলাকার খেজুর গাছ মালিকদের থেকে চার মাসের জন্য গাছ ভেদে পাঁচ থেকে সাত কেজি করে খেজুরের গুড় দিয়ে গাছগুলো আমরা নেই।’
তারা আরও বলেন, ‘চাহিদা মত খেজুর গাছ না পাওয়ার কারণে রস কম হওয়ায় আশানুরুপ গুড় তৈরি করতে পাড়ি না। তারপরও এবছর প্রায় ২০০টির বেশি খেজুর গাছের মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করেছি। বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে না দিয়ে জীবন-জীবিকার জন্য এই পেশা ধরে রেখেছি। তবে যেভাবে খেজুর গাছ কাটা হচ্ছে অল্প দিনের মধ্যেই এই এলাকায় আর আমাদের ব্যবসা হবে না।’
এদিকে বর্তমান বাজারে আখের গুড়, চিনি যে মূল্যে বেচাকেনা হচ্ছে তার চেয়ে মানসম্পন্ন খেজুরের গুড়ের দাম এবছর কিছুটা বেশি হবে এমনটাই আশা করছেন গাছিরা। শীত একটু বেশি পড়তে শুরু করলে আত্মীয়-স্বজন আনা নেয়া ও পিঠা-পুলির উৎসবে খেজুর গুড়ের দাম ও চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সে সময় তাদের লাভ একটু বেশি হয়। যে পরিমাণে শ্রম দিতে হয় সে পরিমাণে লাভ করতে পারে না বলে জানায় তারা।
এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ কাউছার হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেই খেজুর গাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। গাছিদের খেজুর গাছ কাটার কাজটি শিল্প আর দক্ষতায় ভরা। ডাল কেটে গাছের শুভ্র বুক বের করার মধ্যে রয়েছে কৌশল, রয়েছে ধৈর্য ও অপেক্ষার পালা। এ জন্য মৌসুম আসার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ গাছিদের কদর বাড়ে।’
এদিকে উপজেলার সচেতনমহল বলেন, ‘খেজুর গাছ আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য তথা জীবনধারায় মিশে আছে। এই ঐতিহ্যকে যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করতে হবে।’
রাজশাহী বার্তা/admin