এ আর রহমানের মেয়ের বোরকা ও তসলিমার শ্বাসকষ্ট

সময়: 12:25 pm - February 21, 2020 | | পঠিত হয়েছে: 150 বার

খ্যাত ভারতীয় সঙ্গীত পরিচালক এ আর রহমানের মেয়ে খাদিজা যাপন করেন তার নিজ ধর্মীয় জীবন। বোরকা পড়েন। মুখে থাকে নেকাব। এ পোশাকে তার কোনো সমস্যা না হলেও, শ্বাসকষ্ট হয় বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের। আরেকজনের ব্যথায় সমব্যথী হওয়া যায়, কিন্তু ব্যাথা না হলে কিসে ‘সম’ হন প্রশ্নটা সেখানেই।

এ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনার আগে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করে দিই। ‘বংশোদ্ভুত’ শব্দটি ব্যবহার বিষয়ে বলি। তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশের বাইরে আছেন দীর্ঘদিন। তার আক্ষেপ তাকে দেশে ফিরতে দেয়া হচ্ছে না। তার নিজের নাগরিক পরিচয় নিয়ে সম্ভবত তিনি নিজেই দ্বিধায় আছেন। তার কলকাতায় থাকতে চাওয়ার আকুলতা, থাকার প্রশ্নে আক্ষেপসহ নাগরিকতা নিয়ে নানা সময়ে করা নানা উক্তি সেই দ্বিধার অস্তিত্বটা প্রকট করেছে। সেই সংশয়ের রেশ থেকেই ‘বংশোদ্ভুত’ শব্দটির ব্যবহার। শব্দটি সম্ভাব্য উপকারী এবং নিরাপদ।

যাকগে, এখন এ আর রহমানের মেয়ে খাদিজা’র পোশাকের প্রশ্নে আসি। খাদিজা বোরকা পরে। এটা হলো তসলিমার সমস্যা। আমাদের সময়ে ডায়ানা রসে’র গান আমরা খুব শুনতাম। সে সময় ডায়ানা’র একটি পোশাক আমাদের সময়কালীন মেয়েদের খুব আগ্রহের ছিল। কালো প্যান্টের সঙ্গে অনেকদূর পর্যন্ত তোলা বুট। গায়ে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত পড়া গাউন। হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক, চোখে কালো ক্লাস, মাথায় ক্যাপ।

শরীরের কোনো অংশই দেখা যায় না। আমাদের ছেলেরা তো ওই ড্রেসে রীতিমত ফিদা। মেয়েরা না পড়াতে পারায় ঈর্ষান্বিত। কারণ অমনটা পড়তে গেলেই গার্ডিয়ানরা চটে যাবেন। পাড়ার লোকজন বলবে, বাজে মেয়ে। এমনকি শিক্ষকরাও বলবেন, বখে গেছে। সুতরাং কী আর করা।

ডায়ানা রসে’র সে পোশাকের সঙ্গে এ আর রহমানের মেয়ে খাদিজার বোরকার কি খুব বেশি পার্থক্য রয়েছে? সম্ভবত না। কারণ দুটোই শরীর সম্পূর্ণ ঢেকে রেখেছে। বরং ডায়না রসের চোখ দুটোও গ্লাসে ঢাকা, খাদিজার চোখ দুটো অন্তত খোলা। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের এক রক গাইয়েকে ডায়না রসের কাছাকাছি পোশাকে দেখেছিলাম। সম্ভবত তার নামটা তিশমা। কই তাদের শরীর ঢাকা পোশাক নিয়ে তো কেউ কিছু বলেননি। এছাড়াও তসলিমার স্লিভলেস নিয়েও তো খাদিজা মন্তব্য করেননি। বলেননি, ‘আপনি এতো কম পোশাক পরেন কেনো, আমার শীত লাগে’, এমনটা।

খাদিজা তসলিমা নাসরিনকে গুগল ঘেটে নারীবাদের প্রকৃত মানেটা বুঝতে বলেছেন। আর প্রকৃত মানেটা হলো তসলিমার স্লিভলেস দেখে ‘আমার শীত লাগে’ না বলাটা। তসলিমার পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারে কটাক্ষ না করাটাই নারীবাদ।

খাদিজা তার কাজ করছে, আপনি আপনার কাজ করুন। খাদিজা যতক্ষণ সমাজের জন্য ক্ষতিকর কোনো কাজ না করছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত, সে সমালোচনার বিষয়বস্তু নন। এক সময়ের পাকিস্তানের বিখ্যাত রক গায়ক জুনায়েদ জামশেদ পরবর্তীতে ধর্মে মন দিয়েছিলেন। ধর্মীয় গান গেয়েছেন। তিনি যেটা ভালো বুঝেছেন করেছেন। সেটা তার ব্যক্তি স্বাধীনতা। সেতো অন্য কারো ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেননি।

ব্যক্তিকে তার স্বাধীনতা দেয়াই আধুনিকতা। ‘সেকুলারিজম’টাও তাই। নারীবাদও সেই কথা বলে, স্বাধীনতার কথা। নারীকে স্বাধীনভাবে জীবন-যাপন করতে দেয়া। সে ধর্মে না জিরাফে থাকবে তাকে নির্ধারণের অধিকার দেয়া। যদি তার ওপর কোনো একটা বিষয়ে জোর করা হয় তখন তা আলোচনার বিষয়। খাদিজা’র ওপর পোশাক বা ধর্ম পালনে জোর করা হয়নি, সেটা তার জবাবেই তিনি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার পোশাকের জন্য আপনি শ্বাসরুদ্ধ বোধ করছেন, এতে আমি দুঃখিত। অনুগ্রহ করে তাজা বাতাস নিন, কারণ আমি আদৌ দমবন্ধ অনুভব করছি না। বরং আমি যা করছি, তার জন্য গর্বিত।’

খাদিজা যদি তার কাজে গর্বিত হন, তাতে অন্যের সমস্যাটা কী! নারীবাদ দর্শনের একটা অংশ। সেকুলারিজমও তাই। ধর্মও দর্শন। দর্শনের কাজ হলো দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে দেয়া। যাতে আমরা নিজেদের বিবেচনায় সঠিক বিষয়টি বেছে নিতে পারি। এই বিবেচনা সবার এক হবে কিংবা হতেই হবে এমন ভাবাটাই উগ্রতা। র‌্যাডিক্যালিজম। আমার মতটাই সঠিক এটা নিয়ে জোর করার চেষ্টা কিংবা অন্যের মতকে অপদস্ত করার চেষ্টাও তাই।

এটাকে মতান্ধতাও বলতে পারেন, ডগমাটিজম। একজনের কাজ যতক্ষণ অন্যজনের অসুবিধার কারণ না ঘটাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সেই কাজে বাধা দেয়ার অধিকার কেউই সংরক্ষণ করেন না। যারা করেন, তারা র‌্যাডিক্যাল কিংবা ডগমাটিক।

ধর্ম তখনই সমালোচনায় আসে যখন সে অন্য দর্শনের ওপর জোর খাটায়, তাকে বাধাগ্রস্ত করে, কটাক্ষ করে। বিপরীতে ধর্মকে বাধাগ্রস্ত করা হয় কিংবা কটাক্ষ করা হয়, যারা করেন বা যে দর্শন করে তাও আপত্তিকর, সমালোচনা বিষয়। এক হিন্দু সাধুর ছবি দেখলাম, হিমালয়ে বসে ধ্যান করছেন প্রচন্ড ঠান্ডায়। আরেক কবিকে দেখলাম নেপালে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করছেন।

ক্যাপশান দিচ্ছেন, অপূর্ব। আমি সেই সাধু আর ওই কবি’র মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য দেখি না। কবি নিজ আত্মতৃপ্তি খোঁজার জন্য নেপাল গিয়েছেন, সাধুও তাই। কবি সাধুর মাথা ভাঙতে যাননি, সাধুও তাকে ভস্ম করেননি। তাহলে সমস্যাটা কোথায়। সমস্যাটা হলো খোঁচানোতো। এই খোঁচানোটাও মানসিক রোগ। চিন্তার দৈন্যতা।

আমি আমার দর্শন থেকে এতটুকু বলতে পারি, নারীদের নিজ সৌন্দর্য প্রদর্শনের অধিকার রয়েছে। উল্টো কোনো নারী ভাবতে পারেন, আমি বোরকাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আমি আমার ধারণাটা তাকে জানাতে পারি, সে তা নাও মানতে পারে, অটল থাকে পারে তার ধারণায় এটা তার অধিকার এবং সে অধিকার মৌলিক। কিন্তু তার বোরকাতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে এমন বলাটা আমার শারীরিক নয় মানসিক অস্বস্তি।

কিংবা মানসিক বৈকল্য। কারণ অন্যের কষ্ট বোধ করার শারীরিক ক্ষমতা কাউকে দেয়া হয়নি, যতক্ষণ না তা নিজের শরীরে ঘটে। ঈথারে কষ্ট ছড়ায় না, সহমর্মিতা ছড়ায় এবং সেই সহমর্মিতা ভুলও হতে পারে।

‘ভারী’ দর্শনে ‘আসক্ত’রা বলতে পারেন, এসব তো খুব হাল্কা ‘কথা’ হয়ে গেল। তাদের বলি, এই যে ‘আসক্ত’ শব্দটি ব্যবহার করলাম তা হলো নেতিবাচক, ইতিবাচক হলো ‘অনুরক্ত’। যারা অনুরক্ত তারা হালকা কথাতেই বোঝেন, আর আসক্তদের বোঝার ক্ষমতাই রহিত হয়ে যায়।

ভারী তত্ত্ব তাদের আরো ‘আউলা’ করে দেয়। যেমন হয় নেশাখোরদের ক্ষেত্রে। আসক্তি আসে নেশা থেকেই। আর নেশা সবসময়ই বোধহীন, উপলব্ধিহীন। সেটা হোক ড্রাগসের বা আলোচনা-সমালোচনায় থাকার নেশা।

রাজশাহী বার্তা/admin

এই বিভাগের আরও খবর