গ্রামে অনলাইনে খাবার বিক্রি, চয়নের মাসে আয় ৪০ হাজার টাকা

সময়: 10:02 am - June 3, 2021 | | পঠিত হয়েছে: 142 বার

ভেজালের ছড়াছড়ি যখন চারদিক, তখন স্বাস্থ্যকর খাবার কে না চায়! এ কারণে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার তামাই গ্রামের (টিএফসি) একটি অনলাইন খাবারের দোকান। নিজের তৈরি খাবার নিয়ে পরিচয় তৈরি করার চেষ্টা করছেন তরুণ ব্যবসায়ী জাকিয়া আফরোজ চয়ন।

বাড়িতে খাবার তৈরি করে গ্রামের মেঠো পথে বাবা-মেয়ে ছুটছেন গ্রাহকের বাসায়। অর্ডার করলেই বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছেন বিরিয়ানি, রাইসবোল, পাস্তা, পিৎজা, বার্গার, কাচ্চি, তেহারি, চিকেন ফ্রাই, শর্মা, চাইনিজসহ হরেক রকমের খাবার।

জাকিয়া আফরোজ চয়ন ঢাকার একটি বেসরকারি কলেজ থেকে স্নাতক (সম্মান) শেষ করে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয়েছেন। সেই সময়ই দেশে হানা দেয় করোনা। দীর্ঘ ছুটিতে আটকে যান তিনি। বাবার ওয়ার্কশপ ও বাড়িতে থাকা তাঁতের ব্যবসাটাও করোনার থাবায় বন্ধ হয়ে যায়।

তখন ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসে শুরু করেন অনলাইনে খাবারের ব্যবসা। মাত্র আড়াই হাজার টাকা নিয়ে গত ডিসেম্বরে শুরু করেন গ্রাম ভিত্তিক বাহারি খাবারের অনলাইন দোকান। এই উদ্যোগেই আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি চয়নকে। ছোট দুই বোনের সহযোগিতায় স্বপ্ন দেখছেন সফল একজন নারী হওয়ার। বাবা নাসিমুল গণি জুয়েল নিজেই খাবার সরবরাহ করে মেয়েকে উৎসাহ দিচ্ছেন। মাও সহযোগিতা করেন রান্না ও প্যাকেটিংয়ের কাজে।

জেলার বেলকুচি উপজেলার তামাই গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান জাকিয়া আফরোজ চয়ন, জুলিয়া আফরোজ নয়ন ও নুসরাত জেরিন অয়ন। চয়নের উদ্যোগে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ধরনের খাবার এখন অনলাইনে মিলছে উপজেলার তামাই গ্রামে। শহরের নামিদামি সব খাবার খুব স্বল্প দামে গ্রামের মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছেন তিন বোন। মাত্র কয়েক মাস ধরে চলছে তাদের অনলাইন রেস্তোরাঁ। আর এতেই বিক্রি হচ্ছে দিনে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। যার থেকে আয় থাকছে প্রায় অর্ধাংশ। শুধু তাই নয় এখানে পাওয়া যায় চাহিদা মতো সব খাবার। তবে দুই ঘণ্টা আগে অর্ডার দিলেই বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছে খাবার। খাবারের মান নিয়েও প্রশংসায় ভাসছেন তারা।

তিনি আরও বলেন, বাবার ওয়ার্কশপ ও বাড়িতে থাকা তাঁতের ব্যবসাটাও করোনার থাবায় বন্ধ হয়ে যায়। তাই বাবাকে কীভাবে সহযোগিতা করা যায়, সেই চিন্তায় পড়েন তিন বোন। বড় কোনো পুঁজিও হাতে নেই। করোনার এই সময়ে গ্রামে বসে অলস সময় কাটানো মোটেই ভালো লাগছিল না তাদের। তাই চয়ন প্রথমে অনলাইনে একটি ফেসবুক পেজ খুলে সিরাজগঞ্জের তাঁতকুঞ্জে উৎপাদিত শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি পিস বাজারজাত করতে শুরু করেন। কিন্তু এই ব্যবসায় পুঁজির অভাবে খুব একটা আলোর মুখ দেখছিল না। তখন হঠাৎ চয়নের মাথায় আসে কীভাবে শহরের মতো গ্রামেও একটি অনলাইন রেস্তোরাঁ চালু করা যায়।

গ্রামে খাবারের তেমন ভালো রেস্তোরাঁ নেই, তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখানেই একটি অনলাইন রেস্তোরাঁ চালু করলে সাড়া মেলার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বাইরে দোকান দিতে তো অনেক অর্থের প্রয়োজন, যা তাদের নেই। তাই ফেসবুক ব্যবহার করে হোম ডেলিভারির চিন্তা করেন। সেই চিন্তা-ভাবনা নিয়ে ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর শুরু করেন অনলাইনে পোশাক ব্যবসার পাশাপাশি খাবারের ব্যবসা। তামাই ফুড কার্ট-টিএফসি নামে অনলাইন রেস্তোরাঁ। সে থেকে এখন পর্যন্ত আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের।

তিনি আরও বলেন, মাত্র আড়াই হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেছিলাম। এখন অনেক ভালো অবস্থা। শুধু আমার গ্রাম নয়, দূর-দূরান্ত থেকে অর্ডার আসে। মাত্র পাঁচ মাসে টিএফসি এখন নিজ গ্রামসহ আশপাশের এলাকার সব মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু ডেলিভারির ব্যবস্থা না থাকার কারণে দূরের অর্ডারগুলো সরবরাহ করতে পারি না।

বাহারি খাবার রান্নার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার কখনো প্রফেশনালি রান্না শেখা হয়নি। ছোটবেলা থেকে মায়ের রান্না দেখতাম। রান্নার প্রতি ঝোঁক থেকেই রান্না পছন্দ করি৷ সেই রান্না দিয়েই আজ স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি করোনার সময়ে পুরো পরিবারকেও সহযোগিতা করতে পারছি। ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে কিছু করার স্বপ্নও লালন করছি।

টিএফসিতে বিরিয়ানি, রাইসবোল, পাস্তা, পিৎজা, বার্গার, কাচ্চি, তেহারি, চিকেন ফ্রাই, শর্মা, চাইনিজ খাবারসহ নানা ধরনের প্রায় ২০টি আইটেমের খাবার অর্ডার অনুযায়ী তৈরি হয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় পিৎজা, বার্গার, রাইসবোল। পিৎজা বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ২৭৫ টাকায়, রাইসবোল ৯৯ টাকায়, বার্গার ৯৯ থেকে ১৫০ টাকায়। এছাড়াও সাধ্যের মধ্যে বিভিন্ন খাবার চাহিদা অনুযায়ী বিক্রি হয়ে থাকে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত প্রায় ১২টা পর্যন্ত খাবারের অর্ডার আসতে থাকে। তবে তুলনামূলক বিকেলে ও প্রতি শুক্রবারে অর্ডার বেশি হয়ে থাকে। জেলার বেশ কিছু গ্রাম ও শহর থেকে খাবারের চাহিদা আসছে। তবে জনবল ও পুঁজি কম হওয়ায় সরবরাহ করা সম্ভব হয় না।

চয়ন বলেন, গ্রামে বসে শুধু একটি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অনলাইন রেস্তোরাঁ চালিয়ে যে সফল হওয়া যায়, তা আসলে ভাবতেই অবাক লাগে। উদ্যোক্তা হওয়ার পর নিজেকে স্বাধীন মনে হয়। আগের জীবনটা ছিল ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে। ভেবে ভালো লাগে, আমাদের কারণে আরও কিছু মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে। বাবা অর্ডার অনুযায়ী মোটরসাইকেলে যথা সময়ে খাবার সরবরাহ করে থাকেন। দুই বোন ও মা খাবার প্রস্তুত করতে সহায়তা করেন। পাশাপাশি অর্ডার বেশি থাকলে আরও তিন নারী আমার সহায়ক হিসেবে কাজ করেন।

স্থানীয় কয়েকজন প্রতিবেশি বলেন, প্রায় পাঁচ মাস আগে অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের খাবার বিক্রি শুরু করেছেন চয়ন। অনেকেই ভেবেছিল এটা তেমন কিছু হবে না, কিন্তু এখন তারাই তার প্রশংসা করছেন। তবে গ্রামে বসে এতটা অল্প দামে শহরের সব খাবার পেয়ে গ্রামবাসী আনন্দিত।

মেয়ের সাফল্যের বিষয়ে বাবা নাসিমুল গণি বলেন, গ্রাম পর্যায়ে এমন একটি ডিজিটাল উদ্যোগ সফল হতে পারে, প্রথমে আমরা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এখন দেখছি, অনলাইনে বিশাল একটি বাজার আছে। যেখানে দেশের অনেক তরুণ উদ্যোক্তা অংশ নিতে পারেন।

তিনি আরও বলেন, ছোট মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেলে গিয়ে খাবার যথাসময়ে পৌঁছে দেই। খাবার খেয়ে সবাই প্রশংসা করেন। মেয়ের এমন উদ্যোগে সত্যিই শুরুতে অবাক হয়েছিলাম। এখন এই উদ্যোগেই সংসারে সচ্ছলতা আসছে। স্বপ্ন আছে ভালোমানের একটা রেস্তোরাঁ দেবো।

রাজশাহী বার্তা/admin

এই বিভাগের আরও খবর