রাজশাহী শাখার ব্যাংকের ভল্ট থেকে সাড়ে ৩ কোটি টাকা সরিয়ে ক্রিকেট জুয়ায় মাতেন ফয়সাল
বেসরকারি প্রিমিয়ার ব্যাংকের রাজশাহী শাখার ক্যাশ ইনচার্জ শামসুল ইসলাম ওরফে ফয়সাল ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা সরিয়ে ক্রিকেট জুয়ায় অংশ নেয়ার তথ্য স্বীকার করেছেন। বৃহস্পতিবার বিকালে তিনি রাজশাহী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ২–এর বিচারক সাদেকিন হাবিবের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এতে তিনি ব্যাংকের ভল্ট থেকে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা সরিয়ে জুয়া খেলার কথা স্বীকার করেন।
ফয়সাল জবানবন্দিতে বলেন, কৌশলে ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা সরাতেন। ভল্টে সবসময় প্রায় ১৫ কোটি টাকা থাকত। তিনি সামনের লাইন ঠিক রেখে পেছনের লাইন থেকে টাকা সরাতেন, যাতে কারও সন্দেহ না হয়। এই করে তিনি ৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যাংক থেকে সরিয়েছেন। এর পর এই টাকা দিয়ে তিনি জুয়া খেলেছেন। একটি অ্যাপের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক জুয়াড়িচক্রের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শাহীন আকতার জানান, ক্রিকেট জুয়া খেলে ব্যাংকের ক্যাশ খোয়ানোর কথা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন ফয়সাল। ব্যাংকের নথিপত্রও তাই প্রমাণ করছে।
প্রায় তিন কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ব্যাংকের করা মামলায় গত শুক্রবার রাতে পুলিশ ফয়সালকে গ্রেফতার করে। সোমবার তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বোয়ালিয়া মডেল থানা পুলিশ।
ব্যাংক সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার সপ্তাহের লেনদেন শেষে ক্যাশ ব্যালান্সে সাড়ে তিন কোটি টাকা ঘাটতির বিষয়টি ধরা পড়ে। এরপরই ফয়সালকে আটক করে টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করে শাখা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তা সম্ভব না হওয়ায় শুক্রবার ভোরের দিকে তাকে বোয়ালিয়া মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়। ওইদিনই ব্যাংকের রাজশাহী শাখার ম্যানেজার সেলিম রেজা খান বাদী হয়ে তিন কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ফয়সালের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
এদিকে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকটির স্থানীয় শাখার কর্মকর্তারা মুখ খুলতে না চাইলেও পুলিশ জানিয়েছেন, ক্রিকেট জুয়ায় জড়িয়ে দিনে দিনে ব্যাংকের ক্যাশ থেকে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা সরিয়ে ফতুর করে দেন ফয়সাল।
ফলে ক্যাশের ঘাটতি পূরণের জন্য ফয়সালের কাছে এখন কোনো টাকা নেই। অনলাইন জুয়ায় হেরে ফয়সাল নিজের কিছু টাকা দিয়ে ব্যাংকের ক্যাশ ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
ফয়সালের বাবার নাম নজরুল ইসলাম। রাজশাহী নগরের সাগরপাড়ায় তার বাড়ি। নগরীতে ফয়সালের একটি বড় কোচিং সেন্টারের চারটি শাখাও রয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স করা ফয়সালের নগরীতে একটি কোচিং সেন্টার রয়েছে, যার চারটি শাখাও রয়েছে। সেখান থেকে ফয়সাল বছরে এক থেকে দেড় কোটি টাকা আয় করতেন। সেই টাকার বেশিরভাগই সে অনলাইন ক্রিকেট জুয়ায় শেষ করেছেন।
পুলিশ ফয়সালের বাবা ও স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, ফয়সাল চাকরিতে যে বেতন পান তার কোনো টাকা পরিবারে দিতেন না। আজ রিমান্ড শেষে তাকে আবার আদালতে তোলা হবে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
ফয়সালকে জিজ্ঞাসাবাদ ও ব্যাংকের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকেই ক্রিকেটের অনলাইন জুয়ায় ব্যাংকের ক্যাশ দিয়ে ডলার করে জুয়া খেলতেন ফয়সাল।
খেলা শুরুর এক মাসের মধ্যে তিনি ক্যাশের কোটি টাকা হারিয়ে ফেলেন। ২০১৯ সালে একইভাবে হারিয়েছেন আরও দুই কোটি টাকা। ভারতের মুম্বাই ও দিল্লিভিত্তিক একটি অনলাইন ক্রিকেট জুয়ার ঠিকানা পাওয়া গেলেও পুলিশ তদন্তের স্বার্থে সেই নামটি প্রকাশ করেনি। এই তিন কোটি টাকা গেছে অনলাইন পেমেন্ট হিসেবে। প্রথমে ব্যাংকের ক্যাশ থেকে সরাসরি ডলার হয়ে অনলাইন ক্রিকেট বেটিং চক্রের হিসাবে ঢুকে পড়েছে।
বোয়ালিয়া মডেল থানার ওসি নিবারণ চন্দ্র বর্মণ জানান, গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ক্যাশ অফিসার ফয়সাল দাবি করেছিলেন তিনি দুই কোটি টাকা দুই বন্ধুকে দিয়েছেন আর বাকি এক কোটি টাকা নিজের নামে অন্য ব্যাংকে থাকা তার নিজের হিসাবে স্থানান্তর করেছেন। কিন্তু ব্যাংকের নথিপত্র পর্যালোচনা করে টাকা স্থানান্তরের কোনো প্রমাণ পায়নি পুলিশ।
ফয়সাল পুলিশকে জানিয়েছেন, জুয়া খেলতে ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা চুরি করেছিলেন। ব্যাংকের রাজশাহী শাখার ভল্টে সব সময় প্রায় ১৫ কোটি টাকা থাকত। সামনের লাইন ঠিক রেখে পেছনের লাইন থেকে তিনি টাকাগুলো সরাতেন। এতে করে ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তার সন্দেহ হতো না। ক্যাশ ইনচার্জ হিসেবে তিনিই দৈনিক টাকার হিসাব রাখতেন। খাতা-কলমে টাকার কোনো গরমিল ছিল না। তিনি স্বীকার করেছেন, একটি অ্যাপের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক জুয়াড়িচক্রের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
রাজশাহী বার্তা/admin