সাঁটলিপি বা শর্ট হ্যান্ড লেখার নিয়ম

সময়: 10:56 pm - June 16, 2020 | | পঠিত হয়েছে: 998 বার

শর্টহ্যান্ড কাকে বলে ?
ইংরেজি �Shorthand� এর আভিধানিক অর্থ হলো সংকেত লিপি বা সাঁটলিপি। আধুনিক প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে চিঠিপত্র, বক্তৃতা, বিবৃতি ইত্যাদি কম সময়ে নির্ভুলভাবে লেখার জন্য এটা কার্যকরী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। সাধারণ অর্থে, দ্রুত লেখার বিশেষ সংকেত ব্যবহার করে দ্রুত লিপিবদ্ধ করার কৌশলই হলো শর্টহ্যান্ড বা সাঁটলিপি।

ব্যাপক অর্থে, উচ্চারণের ওপর ভিত্তি এবং সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করে যেকোনো আলোচনা, পর্যালোচনা, বিবৃতি, ধারাবিবরণী, বক্তৃতা, বির্তক, কথোপকথন ইত্যাদিকে সাধারণ লেখার তুলনায় অধিক দ্রুত গতিতে নির্ভুলভাবে লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থাকে শর্টহ্যান্ড বা সাঁটলিপি বলে।

নিম্নে শর্টহ্যান্ডের কয়েকটি জনপ্রিয় সংজ্ঞা প্রদান করা হলো : * John Robert Gregg-এর মতে, “শর্টহ্যান্ড হলো একটি কৌশল যা আধুনিক বিশ্বে উন্নত বাণিজ্যে তথ্য দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন হয়।” (Shorthand is a vital skill is the fast-paced world of business, a world in which recording data quickly and accurately is a necessity.)
* Sir Isaac Pitman-এর মতে, “মুখে উচ্চারিত শব্দসমূহ চিহ্নের সাহায্যে প্রকাশকে শর্টহ্যান্ড বলে।” (The art of representing spoken sounds by character; a system of shorthand.)
* The Oxford English Dictionary-তে বলা হয়েছে, “সংকেতের সাহায্যে পত্র, শব্দ ইত্যাদি দ্রুত লেখার কৌশলকে শর্টহ্যান্ড বলে।”

* The new Encyclopaedia Britannica- তে বলা হয়েছে, “যে পদ্ধতি দ্বারা চিহ্ন অথবা সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করে বর্ণ, শব্দ বা শব্দগুচ্ছ লেখা হয় তাকে শর্টহ্যান্ড বলে।”
The Encyclopaedia Americana- তে বলা হয়েছে, “যে লেখার পদ্ধতি দ্বারা সাধারণ উচ্চারিত শব্দগুলো বিশেষ ধরনের সাংকেতিকচিহ্নের সাহায্যে লেখা হয় তাকে শর্টহ্যান্ড বলে।”

উপরের আলোচনা ও সংজ্ঞার আলোকে শর্টহ্যান্ডের যে বৈশিষ্ট্যগুলো পাওয়া যায় তাহলো:
ক) এটি সংকেত চিহ্নের মাধ্যমে লেখার কৌশল বিশেষ।
খ) এটি উচ্চারণ নির্ভর একটি বিষয়;
গ) এটি দ্রুত লেখার কৌশল;
ঘ) এটি একটি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি।

পরিশেষে বলা যায়, শর্টহ্যান্ডকে আধুনিক পৃথিবীতে প্রচলিত ভাষার সংক্ষিপ্ত রূপ বলা হয়। এর মূল ভিত্তি হলো ভাষা। শর্টহ্যান্ড হলো এমন একটি কলাকৌশল যার মাধ্যমে কোনো কিছু শ্রবণ বা বলার সাথে সাথে দ্রুততার সাথে লেখা যায়।

শর্টহ্যান্ডের গুরুত্ব/প্রয়োজনীয়তা আলোচনা : আধুনিক প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অফিস-আদালতে শর্টহ্যান্ডের গুরুত্ব ও ভূমিকা অপরিসীম। এর সাহায্যে অফিসের যাবতীয় কার্যাবলি অতি সহজে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সম্পাদন করা যায়। বিশেষ করে শ্রুতলিপি (Dictation) নেয়ার সময় এর কোনো বিকল্প নেই। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন মানুষ স্বাভাবিকভাবে মিনিটে ৬০টি শব্দ মুখে উচ্চারণ করতে পারে। কিন্তু কোনো মানুষ মিনিটে ৬০টি শব্দ লিখতে পারে না। অথচ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মুখে উচ্চারিত বা বক্তৃতায় বিবৃত সব শব্দই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এসব কথা ধরে রাখার জন্য শর্টহ্যান্ডের মতো একটি কৌশল প্রয়োজন। তাছাড়া শর্টহ্যান্ড শুধুমাত্র অফিস-আদালতেই সীমাবদ্ধ নয়। ব্যক্তিগত ডায়েরি, শ্রেণী কক্ষের পড়া ইত্যাদি শর্টহ্যান্ডের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করা যায়।

১। সময়, শ্রম ও অর্থ বাঁচায়: আধুনিক বিশ্বে বর্তমানে সময়, শ্রম ও অর্থ বাঁচিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হবার প্রচেষ্টা চলছে। কেননা ব্যবসায়-বাণিজ্যের মূল উদ্দেশ্য হলো সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা। এজন্য অনেক শ্রমের কাজ অল্প শ্রমে, অনেক সময়ের কাজ অল্প সময়ে এবং অনেক খরচের কাজ অল্প খরচে সম্পন্ন করার জন্য শর্টহ্যান্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ, শর্টহ্যান্ড ব্যবহারের ফলে একাধিক লোকের কাজ একজন দক্ষ সাঁটলিপিকার একাই করতে পারে। তাই শর্টহ্যান্ড প্রতিষ্ঠানের সময় ও শ্রম বাঁচিয়ে ব্যয় হ্রাসে সাহায্য করে।

২। দ্রুত কার্য সমপাদন: ঊর্ধ্বতন নির্বাহীর নিকট থেকে যেকোনো সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর তা কার্যে পরিণত করার জন্য সাঁটলিপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কেননা এর সাহায্যে একজন সাঁটলিপিকার জরুরি পত্রাদির আদান-প্রদান, বিভিন্ন জরুরি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ইত্যাদি কার্য দ্রুত সম্পাদন করতে পারে। এক্ষেত্রে উক্ত কাজের জন্য নির্বাহীকে দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয় না।

৩। দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ: মানুষের চাহিদা, আচার-আচরণ, রুচি, ফ্যাশন প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। তাই এসব বিষয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানকে পণ্যদ্রব্য উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি করতে হয়। এজন্য প্রতিষ্ঠানকে পণ্যের অর্ডার, পত্রের জবাব, বিজ্ঞাপন, আমদানি-রপ্তানির আনুষ্ঠানিকতা ইত্যাদির জন্য তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এক্ষেত্রে শর্টহ্যান্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

৪। কর্মসংস্থান সৃষ্টি/বেকারত্ব হ্রাস: বর্তমান বিশ্বে বিশেষ করে বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার অভাবে জনসংখ্যার বিরাট একটা অংশ বেকার সমস্যায় জর্জরিত। এ পরিস্থিতিতে বেকার যুবক ও যুবতি শর্টহ্যান্ড শিক্ষা লাভ করে বিভিন্ন সরকারি ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকুরির ব্যবস্থা করতে পারে। ফলশ্রুতিতে বেকার সমস্যার সমাধান যেমনি হয় তেমনি জীবনযাত্রার মানও বৃদ্ধি পায়। সর্বোপরি দেশের কল্যাণ সাধিত হয়।

৫। গোপনীয়তা রক্ষা / নিরাপত্তার প্রতীক: প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কাগজপত্র যেমন-চিঠিপত্র, ডায়েরি, দলিল দস্তাবেজ, রিপোর্ট ইত্যাদি শর্টহ্যান্ডের মাধ্যমে লেখা হলে সাধারণ লেখার চেয়ে অধিক গোপনীয়তা রক্ষা সম্ভব হয়। কারণ শর্টহ্যান্ড সবাই পড়তে পারে না। তাই শর্টহ্যান্ডকে নিরাপত্তার প্রতীক বলা হয়।

৬। ভাষায় দক্ষতা অর্জন: শর্টহ্যান্ড লেখা হয় মুখে উচ্চারণের ওপর নির্ভর করে। তাই তা অনুবাদ করার জন্য একজন সাঁটলিপিকারকে ভাষার জ্ঞান থাকতে হয়। কারণ বিভিন্ন অক্ষর বা শব্দ একই চিহ্ন দিয়ে লেখা হয় বলে বাক্যের গঠন অনুযায়ী বা অর্থ অনুযায়ী অনুবাদ করতে হয়। তাই বলা যায়, শর্টহ্যান্ড ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে সাহায্য করে।

৭। সাংবাদিকতা: সাংবাদিকতা একটি রোমাঞ্চকর পেশা। এ পেশায় সবসময় অতি দ্রুত তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। সাংবাদিকগণ বিভিন্ন সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করে হুবহু সংবাদ মাধামে প্রকাশ করতে চান। এজন্য শর্টহ্যান্ড কার্যকরী অবদান রাখে। কেননা শর্টহ্যান্ড দ্রুত লেখার একটি কৌশল।

৮। যন্ত্রের বিকল্প: বক্তৃতা, বিবৃতি, কথোপকথন, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি শ্রবণের জন্য যন্ত্র একটি অন্যতম মাধ্যম। তবে কোনো কোনো সময় যন্ত্র ব্যবহারের সুযোগ থাকে না, আবার কোনো কোনো ব্যক্তির জন্য এটি ব্যয়বহুল। সেজন্য এসব ক্ষেত্রে শর্টহ্যান্ডের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

৯। ভাল ফলাফল: একজন শিক্ষার্থীর যদি শর্টহ্যান্ড জানা থাকে তবে সে তার শিক্ষকের বক্তব্য হুবহু লিপিবদ্ধ করে এবং পরবর্তীতে সে অনুবাদ করে। ফলে তার লেখাপড়া অনেকটা ব্যবহারিক শিক্ষার মতো হয় বলে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জন করতে পারে।

১০। যোগাযোগ: বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে যোগাযোগ ছাড়া সবকিছু অচল। তাই একজন সাঁটলিপিকার তার নির্বাহীর কোনো সিদ্ধান্ত শর্টহ্যান্ডে লিখে অনুবাদ করে যথাস্থানে প্রেরণ করে। ফলে লিখিত যোগাযোগ দ্রুত সম্পাদন সম্ভব হয়।

১১। সুষ্ঠুভাবে অফিস পরিচালনা: অফিস ব্যবস্থাপনায় সাঁটলিপির গুরুত্ব অপরিসীম। এর সাহায্যে একটি অফিসের কার্যক্রম স্বাভাবিক, অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা যায়। শর্টহ্যান্ডের মাধ্যমে অতি দ্রুত গোপনীয়তার সাথে একটি অফিসের চিত্র তুলে ধরা যায় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। এতে করে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জিত হয় এবং ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতা আসে।

১২। কার্যের দক্ষতা বাড়ায়: শর্টহ্যান্ড কার্যেও দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা করে। এর সাহায্যে অফিস, আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি কার্য অতি সহজে এবং দক্ষতার সাথে সম্পাদন করা যায়।

পরিশেষে বলা যায়, আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে ব্যবসায়-বাণিজ্যসহ সর্বত্র শর্টহ্যান্ডের চাহিদা দিনের পর দিন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের স্বাভাবিক কাজকর্ম সচল রাখা এবং গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য শর্টহ্যান্ডের গুরুত্ব অপরিসীম।

রাজশাহী বার্তা/admin

এই বিভাগের আরও খবর