চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ‘কালাই রুটি’ ফুটপাত হয়ে অভিজাত রেস্তোরাঁয়
বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের সর্বত্র ‘কালাই রুটি’ এখন ভোজনরসিকদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। মরিচ বাটা, পেঁয়াজ কুঁচি ও সরিষার তেল দিয়ে বা পোড়া বেগুনভর্তার সঙ্গে গরম গরম কলাই রুটির প্রসঙ্গ তুলতেই অনেকের জিভে জল এসে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘কলাই রুটির’ আদি উত্স চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মার চরাঞ্চল। স্থানীয় ভাষায় একে বলে দিয়াঢ়। পদ্মার পলি মাটি মাষকলাই চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। সম্ভবত এ কারণে ‘কলাই রুটি’ ছিল পদ্মার চরের মানুষের সকালের লাহারি (নাস্তা)। পুরুষরা ভোরে মাঠের কাজে গেলে বধূরা ‘কলাই রুটি’ লাহারি কাপড়ে মুড়িয়ে পরম যত্নে মাঠে নিয়ে যেতেন। ‘কলাই রুটির’ কারণে অন্য অঞ্চলের মানুষরা চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষদের রসিকতা করে ‘কলাই’ সম্বোধন করতেন। সেই ‘কলাই রুটির’ জনপ্রিয়তা এখন রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল জুড়ে। আগে শীতকালে ‘কলাই রুটি’ খাওয়ার প্রচলন থাকলেও এখন বছর জুড়েই খাওয়া হয়। কালক্রমে ‘কলাই রুটি’ চর থেকে শহরের ফুটপাত হয়ে অভিজাত রেস্তোরাঁয় ঠাঁই নিয়েছে। রাজশাহী অঞ্চলের যে কোনো উত্সবের প্রিয় খাবার এখন ‘কলাই রুটি’। এ রুটি খেলে খিদে কম লাগে।
এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের সময় জানা যায়, দিন দিন বাড়ছে কলাই ডালের চাহিদা ও দাম। আগের মতো কম দামে কলাইয়ের ডাল পাওয়া যায় না। ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও দামের কারণে কলাই রুটিতেও এখন ভেজাল দেওয়া হচ্ছে। মেশানো হচ্ছে কালি কলাই আর মুগডাল। ফলে অনেক জায়গার ‘কলাই রুটিতে’ আগের স্বাদ নেই। ‘কলাই রুটির’ আসল স্বাদ চাইলে বাজার থেকে কলাই কিনে রোদে শুকিয়ে মেশিনে ভাঙিয়ে নেওয়াই উত্তম বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে ‘কলাই রুটির’ স্বাদ নেননি, খুঁজলে এমন মানুষ হয়তো কমই পাওয়া যাবে। অন্যদিকে বাইরের মানুষ রাজশাহীতে এসে ‘কলাই রুটির’ স্বাদ নেন না, এমনটি যেনো হতেই পারে না। তাইতো সাধারণ থেকে সেলিব্রিটিরা পর্যন্ত ‘কলাই রুটির’ স্বাদ নিতে ভুল করেন না।
‘কলাই রুটি’ বানানো কিন্তু খুব সহজ নয়। মাষকলাই ও আতপ চালের গুঁড়ার সঙ্গে স্বাদমতো লবণ ও পানির মিশ্রণে তৈরি খামিরের বল, দুই হাতের তালুর চাপে ঘুরিয়ে ‘কলাই রুটি’ বানাতে হয়। সাধারণ রুটির চেয়ে কলাই রুটি অধিক পুরু ও বড়ো আকৃতির হয়। এ রুটি মাটির পাত্রে (তাওয়া) সেঁকে বাদামি রঙের হলে নামিয়ে পরিবেশন করতে হয়। সাধারণত গরম গরম ‘কলাই রুটি ঝাল-পেঁয়াজ ও পোড়া বেগুনভর্তা দিয়ে খাওয়া হয়। এক্ষেত্রে অতিসাম্প্রতিক সংযোজন হলো ভুনা হাঁসের মাংস দিয়ে কলাই রুটি খাওয়া। সৌখিনরা বাড়িতে মেহমানদের পছন্দমতো গরু, খাসি কিংবা মুরগি ভুনার সঙ্গে কলাই রুটি পরিবেশন করেন। রাজশাহী অঞ্চলে প্রতিটি কলাই রুটির দাম গড়ে ২০ থেকে ২৫ টাকা। অর্ডারে তৈরি স্পেশাল কলাই রুটি সর্বোচ্চ ৩০/৩৫ টাকা, সঙ্গে কাঁচামরিচ বা ধনেপাতা বাটা ও পেঁয়াজ কুঁচি ফ্রি। পোড়া বেগুনভর্তার দাম ৫-১০ টাকা।
রাজশাহীর কুমারপাড়াস্থ সরকারি পিএন গার্লস স্কুলের দক্ষিণপার্শ্বের ‘চাঁপাই কলাই রুটি ঘরের’ মালিক আব্দুর রশিদ বলেন, স্বল্প পুঁজি নিয়ে শুরু ‘কলাই রুটির’ ব্যবসায় তার বর্তমান মাসিক আয় প্রায় ১ লাখ টাকা। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ১টা পর্যন্ত ২০০ থেকে ২৫০ পিস কলাই রুটি বিক্রি হয়। দোকান ভাড়া, বিদ্যুত্ বিল, কর্মচারীর বেতন ও রুটির উপকরণ বাদে যা লাভ থাকে, তাতে ছেলেমেয়ের লেখাপড়াসহ স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার চলে যায়। পাশেই আলো-আঁধারিতে ‘কলাই রুটির’ ব্যবসা করেন মনোয়ারা বেগম। তার এক ছেলে ও মেয়ে অন্য কাজ করেন। স্বামী পদ্মার চরে কৃষিকাজ করেন। দুই জনের সংসারের প্রয়োজন ‘কলাই রুটি’ বিক্রি করেই মিটে যায়।
রাজশাহী বার্তা/admin