জৌলুস হারাতে বসেছে ঝিনাইদহের খেজুরের গুড়
ইটভাটা মালিকরা খেজুর গাছ ক্রয় করে পুড়িয়ে ফেলছেন। আবার অনেক গাছিরা গাছ কাটা বন্ধও করে দিয়েছেন। তাই এখন আর আগের মত হাটে গুড় আসছে না। হয়তো আগামীতে কালীগঞ্জের খেজুর গুড়ের হাট তার জৌলুস ধরে রাখতে পারবে না
“যশোরের যশ, খেজুরের রস” প্রবাদটি বাংলার মানুষের অতি পরিচিত। আবহাওয়ার কারণে এই অঞ্চলটিতে খেজুর গাছ বেশি জন্মে। তাই প্রতিবছর শীত মৌসুমে এখানে পাওয়া যায় প্চুর খেজুর গুড় ও পাটালি। মাটির গুণাগুনে যশোর অঞ্চলের খেজুর রস ও গুড়ের স্বাদ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে অনেক আলাদা।
ঝিনাইদহ বৃহত্তর যশোর অঞ্চলেরই একটি জেলা। জেলাটির কালীগঞ্জ উপজেলা খেজুর গুড়ের জন্য বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। সপ্তাহের প্রতি সোম ও শুক্রবার গুড় ও পাটালি বিক্রির বড় হাট বসে কালীগঞ্জে। তাজা রসের গুড় ও পাটালি এই হাট থেকেই ঢাকা, সিলেট, বরিশাল, ফরিদপুর, মাদারীপুর, কুমিল্লা, খুলনা, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, ঝালকাটিসহ যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
কালীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে গাছিরা তাদের উৎপাদিত খেজুর গুড় ও পাটালি বাজারে বিক্রির জন্য আনেন। বাইরের মোকামীদের কাছে কালীগঞ্জের গুড়ের হাট ব্যাপকভাবে পরিচিত। কিন্তু দিন দিন খেজুর গাছ কমে যাওয়াসহ অনেক গাছিরা গাছ কাটা বন্ধ করে দিচ্ছেন। এ কারণে জৌলুশ হারাতে বসেছে কালীগঞ্জের বিখ্যাত গুড় ও পাটালির সুনাম। তাছাড়া চলতি শীত মৌসুমের প্রথম দিকে বৃষ্টির কারণে এবার বাজারে গুড় উঠেছে অনেক কম।
কালীগঞ্জের হাটে মোকাম করতে আসা কুষ্টিয়ার হরিগোবিন্দপুর গ্রামের নিয়ামত আলী জানান, তিনি ৪৭ বছর ধরে গুড়ের ব্যবসা করছেন। চলতি হাটে তিনি প্রায় ২৫ হাজার টাকা মূল্যে ২৮ ঠিলে (মাটির মাত্র) বা ৭ মণ গুড় কিনেছেন। এসব গুড় তিনি ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি প্রতি কুষ্টিয়া বাজারে পাইকারী ও খুচরা দরে বিক্রি করবেন।
বারবাজার থেকে মোকাম করতে আসা লুৎফর রহমান জানান, তিনি ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে ১৬ মণ ঝোল গুড় কিনেছেন। এসব গুড় ৬০ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি করবেন।
তিনি আরও বলেন, দানা গুড়ের দাম বেশি আর ঝোল গুড়ে দাম কম। এক ঠিলে দানা গুড় ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। আর ঝোল গুড় বিক্রি হয় ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা করে। তিনি ১৮ বছর ধরে গুড়ের ব্যবসা করে আসছেন বলেও উল্লেখ করেন।
কালীগঞ্জের শ্রীরামপুর গ্রামের আলিনুর রহমান জানান, বরিশাল, যশোর, খুলনা, পাইকগাছা, ঝালকাটিসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার মহাজনদের গুড় কিনে ট্রাকে করে সংশ্লিষ্ট জেলায় পাঠিয়ে দেন। বাজারের দাম দর অনুযায়ী মহাজনরা তাকে টাকা পাঠিয়ে দেন। এজন্য অনেক দুরের মহাজনকে কালীগঞ্জের বাজারে আসতে হয় না।
অপরদিকে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বিষয়খালী গ্রাম থেকে পাটালি বিক্রি করতে আসা খলিল বিশ্বাস জানান, তিনি সরাসরি গৃহস্থদের কাছ থেকে কেজি প্রতি ১২০ থেকে ১৪০ টাকা দরে পাটালি কিনে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি প্রতি বিক্রি করছেন। কেজিতে তাদের ১০ থেকে ২০ টাকা লাভ থাকে। দাম ভাল পাওয়া গেলে কখনো কেজি প্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা লাভ হয়।
কালীগঞ্জের স্থানীয় বাসিন্দা তোবারক আলী মণ্ডল জানান, বিভিন্ন স্থান থেকে হাটে আসা মোকামীদের তিনি গুড় কিনে দেন। বড় বড় মোকামীরা ঠিলে (মাটির হাড়ি) থেকে গুড় ঢেলে প্লাস্টিক ড্রামে ভরে নিয়ে যান। ট্রাক, ভ্যান, আলমসাধুসহ বিভিন্ন যানবাহনে এসব গুড় চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়।
কালীগঞ্জ গুড় হাটার ইজারাদার আতিয়ার রহমান জানান, কালীগঞ্জের খেজুর রসের গুড় ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধ। এ গুড়ে কাঁচা রসের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। তাই ব্যবসায়ীদের কাছে আমাদের এলাকার গুড়ের অনেক সুনাম রয়েছে। তাছাড়া শীত মৌসুমে গুড় দিয়ে অনেক পিঠা তৈরি করা হয়। শীতে ক্রয় করা গুড় ব্যবসায়ীরা সারা বছর তা বিক্রি করে থাকেন।
তিনি বলেন, ইটভাটা মালিকরা খেজুর গাছ ক্রয় করে পুড়িয়ে ফেলছেন। আবার অনেক গাছিরা গাছ কাটা বন্ধও করে দিয়েছেন। তাই এখন আর আগের মত হাটে গুড় আসছে না। তবে বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের মধ্যে কালীগঞ্জের খেজুর গুড়ের হাট এখনো টিকে আছে। হয়তো আগামীতে কালীগঞ্জের খেজুর গুড়ের হাট জৌলুস ধরে রাখতে পারবে না।
রাজশাহী বার্তা/admin