রাজশাহীতে থামছে না কৃষিজমিতে পুকুর খনন
পুকুর খনন বন্ধে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা, প্রশাসনের নোটিশ টাঙানো, মেশিন অকেজো করা ও ভ্রাম্যমাণ আদালতে জেল জরিমানা চলছে। তারপরেও রাজশাহীতে থামছে না কৃষি জমিতে অবৈধ পুকুর খনন। যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে পুকুর খনন সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
রাজশাহীতে অবৈধ পুকুর খনন বন্ধে প্রশাসন ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পবা, তানোর, গোদাগাড়ী, মোহনপুর, দুর্গাপুর, বাঘা উপজেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত আছে। পুকুর কাটার সাথে সংশ্লিষ্টদের জেল-জরিমানা ছাড়াও অকেজো করা হচ্ছে মাটি কাটার কাজে ব্যবহৃত এস্কেভেটর মেশিন। পবায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোড়ে মোড়ে টাঙানো হয়েছে পুকুর কাটা বন্ধের নোটিশ। মাইকিং করা হয়েছে বিভিন্ন ইউনিয়নে। এছাড়াও মোহনপুর উপজেলায় পুকুর খননের কাজে ব্যবহৃত মাটিবোঝাই টাক্টর গ্রামীণ রাস্তায় চলাচল নিষিদ্ধে মাইকিং করা হয়েছে। এত কিছুর পরও থামানো যাচ্ছে না পুকুর খনন।
বর্তমানে বেশির ভাগ পুকুর খনন হচ্ছে শুধু মাছ চাষের জন্য নয়, মাটি বিক্রির জন্যও। অবৈধভাবে ট্রাক্টরে মাটি সরবরাহ বন্ধ হলে বিশেষ করে পবা উপজেলার পারিলা-বড়গাছী এলাকায় অর্ধেক পুকুর খনন কমে যাবে এবং রক্ষা পাবে গ্রামীণ রাস্তা। অহরহ ঘটা দুর্ঘটনাও বন্ধ হবে বলে ধারণা সচেতনমহলের।
মানুষ মনে করে পুকুর খনন বন্ধ করতে প্রশাসন ও থানা পারে না-এমনটি হতে পারে না। থানাসহ প্রশাসনের কিছু অসাধু ব্যক্তির কারণেই এমন অবৈধ কাজে সাহস পাচ্ছে প্রভাবশালীরা। প্রশাসনের উদ্যোগে উপজেলার একদিকে কৃষি জমিতে পুকুর খনন বন্ধ হলেও অন্যদিকে ঠিকই চলছে। কয়েকদিন আগে পবা উপজেলার দারুশা হাওয়ার মোড়সহ দর্শনপাড়ার তিনটি পুকুর কাটা বন্ধ করেছে উপজেলা প্রশাসন। কিন্তু একই সময়ে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে পুকুর খনন অব্যাহত রেখেছে উপজেলার বড়গাছী ইউনিয়নের চন্দ্রপুকুর ও দাদপুর বাগিচাপাড়া বিলে।
দাদপুর বাগিচাপাড়ায় পুকুর খনন সিন্ডিকেটের সদস্য বড়গাছির প্রভাবশালী দুই ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারা প্রতিবছর মাটি বিক্রির জন্য তিন ফসলি জমিতে পুকুরখনন করে চলেছেন। তারা পবা পুলিশকে ম্যানেজ করে এবারো পুকুর খনন করছেন। তাদের পুকুর খননে জলাবদ্ধতার আশংকায় লোকজন বাধা দিলে তাদেরকে জেল জরিমানার হুমকিসহ থানা পুলিশের ভয় দেখায় বলে স্থানীয়রা জানান।
এছাড়াও চন্দ্রপুকুরে কয়েকবছর ধরে পুকুর খনন করছেন মতিয়াবিলের হাতেম উদ্দিন ও আজাহার আলী (মেম্বার)। বর্তমানে পুকুর খননের জন্য চন্দ্রপুকুরে পুরোনো আমবাগান কাটা হচ্ছে। আজাহার মেম্বার বলেন, তাদের এই পুকুর খননের মাটি নওদাপাড়া বিএডিসি অফিসে দেয়া হবে। দাম কত কি দিবে সেটা তিনি জানেন না। তার পার্টনার হাতেম আলী জানেন। আবার হাতেম আলী বিষয়টি আজাহার আলীর ওপর গড়িয়ে দেন। তবে পুকুর কাটার কথা স্বীকার করেন দুজনই।
একই অবস্থা চলছে জেলার অন্য উপজেলাগুলোয়। তানোরের চান্দুড়িয়া এলাকার বিলের প্রায় সিংহভাগ জমি এখন পুকুর হয়ে গেছে। একই অবস্থা মোহনপুর উপজেলার বিভিন্ন বিলের। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চলছে এই উপজেলায় পুকুর খনন। অভিযোগ, টাকা দিলেই মিলছে পুকুর খননের সনদ। অন্যদিকে তানোর ও মোহনপুরে চলছে পুকুর খনন বন্ধে ভ্রাম্যমাণ অদালত, জেল-জরিমানা। ৩০ জানুয়ারি তানোরের কলমা ইউনিয়নের আজিজপুর এলাকায় অবৈধভাবে পুকুর খননের দায়ে পুকুর মালিকসহ চারজনকে জেল দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। তাদের এ দÐাদেশ দেন নির্বার্হী ম্যাজিস্ট্রেট ও ইউএনও সুশান্ত কুমার মাহাতো। কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সামাজিক সচেতনতার অভাবেই পুকুর খনন বৃদ্ধি পাচ্ছে যা তাদেরকেও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে।
এদিকে রাজশাহী কৃষি বিভাগের মতে কয়েক বছর ধরেই গোদাগাড়ী, পবা, তানোর, বাগমারা, দুর্গাপুর, পুঠিয়া, মোহনপুর, বাঘা ও চারঘাট এলাকায় ফসলি জমিতে পুকুর-দিঘি খননের হিড়িক চলছে। প্রতি বছরই ছোটবড় ১ হাজার পুকুর কাটা হচ্ছে। গত কয়েক বছরে নতুন ৫ হাজার পুকুর কাটা হয়েছে। এসব পুকুরের কারণে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা।
অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ স্থানীয় প্রশাসন ও থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে চলছে এসব অবৈধ কাজ কারবার। এ কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি। ভুক্তভোগীরা কিছু বললেই চলছে পরোক্ষ ও প্রত্যেক্ষভাবে নির্যাতন। মাদক দিয়ে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে পুকুর খনন সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ। আর জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে প্রশাসনের খবরদারি নিয়েও।
জানা গেছে, উপজেলা প্রশাসন থেকে দিনে অভিযান চালিয়ে যে পুকুর খনন বন্ধ করে, রাতেই আবার সেই পুকুর খনন হচ্ছে। প্রশাসনের অভিযানের আগেই পুকুর খননকারিরা টের পেয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সচেতনমহল অভিযুক্তের তীর ছুঁড়ছে উপজেলা প্রশাসনের ও থানা পুলিশের ওপরে। তারা বলছেন, কোন কোন সদস্য পুকুর খনন সিন্ডিকেটের সাথে আঁতাত করে চলেছে বলেই অভিযানে সাফল্য আসছে না।
গত ২৪ জানুয়ারি মোহনপুর উপজেলার আকুবাড়ি বিলে পুকুর খননের মাটি সরবরাহে অবৈধ ট্রাক্টরের ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছেন ধোপাঘাটা এলাকার এক প্রকৌশলী। ওই প্রকৌশলীর নাম মোতাসিম বিল্লাহ (৪৮)। এছাড়াও সেদিন এক গৃহবধূ গুরুতর আহত হয়েছেন। পুকুর খননের মাটি গ্রামীণ পাকা রাস্তায় পড়ছে। এতে একটু বৃষ্টি হলেই কাদায় রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে অহরহ দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে যানবাহন ও পথচারি।
পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন জানান, হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা ও প্রশাসনের অভিযান সত্তে¡ও অবৈধ পুকুর খনন থামছে না। পুকুর খনন বন্ধে উপজেলার বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে নোটিশ দেয়া হয়েছে। পুকুরে অভিযান চালিয়ে জেল-জরিমানাসহ মেশিনের যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে অকেজো করা হচ্ছে। এই উপজেলায় পুকুর খনন বন্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
রাজশাহী কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ সামশুল হক বলেন, বেশির ভাগ পুকুর কাটা হয়েছে নিষ্কাশন নালা, জলাধারের সেতু-কালভার্টের মুখ বন্ধ করে। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই পুকুর-দিঘি সংলগ্ন কৃষিজমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে হাজার হাজার হেক্টর ঊর্বর জমিতে ফসল ফলাতে পারছেন না চাষিরা। জেলার বিভিন্ন সভায় কৃষি বিভাগ থেকে এসব বিষয়ে একাধিকবার সতর্ক করা হলেও বন্ধ হচ্ছে না পুকুর কাটা।
রাজশাহী বার্তা/admin