শেখ হাসিনার জীবন যেন ফিনিক্স পাখির গাথা
শেখ হাসিনার জীবন যেন পৌরাণিক ফিনিক্স পাখির গাথা। কেউ তাঁর জীবনের পটভূমি সন্ধান করতে চাইলে তা বর্ণনার জন্য এটিই হতে পারে যথাযথ উদাহরণ। পূর্বসূরির ছাই থেকে ফিনিক্সের নতুন জীবন লাভের মতোই গণতন্ত্রের মানসকন্যার উত্থান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাযজ্ঞের পর জাতি যখন দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চয়তার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল, তখন তিনি পরিত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা, ঘটনাক্রমে তার ছোট বোন শেখ রেহানাসহ এই হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। গণমানুষের মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত করার আজীবন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে যে মানুষটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ঘাতকরা তার রক্তের উত্তরাধিকারের পুরো ধারাটিই মুছে দিতে চেয়েছিল।
কিন্তু সর্বশক্তিমানের পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন-বাঙালি নারীর সর্বোত্তম প্রতিমূর্তি শেখ হাসিনা জাতির কাণ্ডারী হতে এগিয়ে আসেন-সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করার জন্যই। ‘আমি আপনাদের মেয়ে, বোন বা মা ছাড়া আর কেউ নই, চাইলেই যার কাছে যাওয়া যায়। আমি দূরের কেউ নই। আমি আপনাদের খুব কাছের,’-তিনি একবার সাক্ষাৎকারে নিজের সর্ম্পকে বলেন।
‘আমার নামটা দেখুন-হাসিনা। এই সহজ ও সাদামাটা নামটি আপনারা গ্রামবাংলা জুড়ে অসংখ্য পরিবারে খুঁজে পাবেন- হা সি না।’ ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ পুনর্গঠনের নতুন অভিযাত্রায় নেতৃত্ব দেয়ার কঠিন মিশন নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশের কয়েক বছর পর তিনি এ মন্তব্য করেন।
১৯৪৭ সালে যখন বিশ্ব ইতিহাস সবেমাত্র প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসানের সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভাজনের উল্লেখযোগ্য পালাবদল প্রত্যক্ষ করছে, ঠিক তখনই বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রত্যন্ত গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারে শেখ হাসিনা জন্মগ্রহণ করেন।
উদারতা ও শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হওয়ার জন্য শ্রদ্ধা অর্জন ছাড়া পরিবারটির তখনো অসাধারণ কিছু ছিল না। প্রকৃতি যখন তাঁর পিতাকে দেশের ভবিষ্যৎ স্থপতি এবং জাতির জনক হিসেবে গড়ে তুলতে রাজনীতিবিদ হিসেবে লালন করছিল, যে কারণে প্রায়ই তাঁকে পরিবার থেকে দূরে থাকতে হতো, প্রিয় কন্যা তখন অন্যান্য সাধারণ শিশুর মতোই টুঙ্গিপাড়া গ্রামের খোলা বাতাসে মধুমতি নদীর তীরে বেড়ে ওঠেন।
শৈশবের স্মৃতিচারণ করে শেখ হাসিনা বলেছেন, তখন তিনি গ্রামের রাস্তায় সমবয়সীদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন, প্রায়ই কাঁচা কুল খুঁজতেন, যা ঐতিহ্যবাহী বাংলার শিশুর আদর্শ জীবনযাত্রা। কীভাবে মাছ ধরা জাল ‘ওচা’ দিয়ে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মাছ ধরতেন তা স্মরণ করতে ভালোবাসেন। কয়েক দশক পরে একদল বাচ্চার সঙ্গে কথোপকথনের সময় শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গ্রামের বাড়িতে গাছে ওঠা, খালে সাঁতার কাটা, মাছ ধরা এবং অন্যের গাছ থেকে কাঁচা আম খাওয়ার মতো দুষ্টুমির কথা বলেন।
‘সেগুলো ছিল আমার জীবনের সেরা সময়,’ বলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। বাড়িতে বাবা-মা’র পাঁচ সন্তানের মধ্যে বড় হওয়ায় তিনি ছিলেন একেবারে ঘরোয়া মেয়ে, বাবা-মা এবং ছোট ভাই-বোনদের প্রতি ছিল যার প্রচণ্ড ভালোবাসা। প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিতি এবং গ্রামের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা তার মধ্যে মানুষের পাশাপাশি পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা, সামাজিক বন্ধন এবং ঐতিহ্যগত বুদ্ধিমত্তা বা লোকায়ত জ্ঞান বোঝার দক্ষতা তৈরি করেছে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পারিবারিক মূল্যবোধের সঙ্গে এই বোধজ্ঞান এবং প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা মূল চরিত্র গড়ে তুলেছে।
গ্রামের সঙ্গে অবিশ্বাস্য ও চিরন্তন যোগসূত্র সত্ত্বেও প্রশংসকারী বা সমালোচক নির্বিশেষে যে-কেউ শেখ হাসিনার স্বাভাবিক স্মার্টনেস, প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি, সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ এবং চেহারা, পোশাক ও আলাপচারিতায় তার অনন্য স্টাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে তাকে নাগরিক বলেবেন।
বঙ্গবন্ধু কন্যার বেশ কয়েকজন অন্তরঙ্গ বন্ধু স্মরণ করেন, তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন; তখন তার ব্যক্তিগত বইয়ের শেলফ উঁচুমানের সাহিত্য এবং মহৎ ব্যক্তিদের জীবনীতে ভর্তি ছিল। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য পছন্দ করেন। কবি কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ ও সুকান্ত ভট্টাচার্যও প্রিয় লেখক। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের বিখ্যাত পথের পাঁচালী প্রিয় উপন্যাস। সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ তাকে মানব প্রকৃতি ও জীবনকে বোঝার জন্য অতিরিক্ত চোখ দিয়ে সমৃদ্ধ করেছে, যা তার মাপের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতিবিদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গুণ।
ঘনিষ্ঠ লোকেরা বা যারা একজন ‘পাবলিক ফিগার’ হিসেবে শেখ হাসিনার ওপর নজর রাখেন, তারা তার মধ্যে সঙ্গীত, চলচ্চিত্র ও ইতিহাসের প্রতিও অনুরাগ খুঁজে পান। আওয়ামী লীগ সভাপতির ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে তিনি একজন বোদ্ধা হিসেবে কবি, গায়ক বা সংগীতশিল্পী ও অভিনেতাদের সম্পর্কে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করে থাকেন।
পরিচিতরা বলেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে রাজনীতির পাশাপাশি চলচ্চিত্র, টিভি সিরিয়াল, সাহিত্যের প্রবণতা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের মতো ব্যাপক বিষয়ে বিতর্ক করা যায়। জন্মগত নেতৃত্বের গুণ, অমিত প্রাণশক্তি, অসাধারণ হাস্যরসবোধ, মমতাময় মন এবং মর্যাদাবোধ তাকে তিনি যেখানে ছিলেন এবং আছেন প্রতিটা ক্ষেত্রের কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করেছে।
‘আমি ছোটবেলা থেকেই দেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতন এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত ছিলাম,’ একবার এক নিবন্ধে লিখেছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময় নিজের বাবা এবং তাঁর সহকর্মীরা যে অসহনীয় অত্যাচার সহ্য করেন তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। যখন তার মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকেও পরিবার এবং দলকে নেপথ্যে পথনির্দেশনা দিতে দেখেন। বর্তমান সরকার প্রধান লিখেছেন, ‘রাজনীতিতে আমার প্রথম পাঠ এসেছে আমার পারিবারিক পরিবেশ থেকে।’
তবে তাঁর বিষয়টি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে সাজানো-গোছানো মঞ্চে এসে ভাগ্যবান রাজকন্যার হাজির হওয়ার মতো ছিল না। এটি আসলে এমন এক মেয়ের অভিজ্ঞতা যিনি বাবাকে ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও সুযোগ-সুবিধা ত্যাগ করে সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করতে দেখে বেড়ে উঠেছেন। তিনি প্রত্যক্ষ করেন, তার পিতার সংগ্রাম প্রায়ই তাঁকে ও পরিবারকে তীব্র দুর্দশার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। পুত্র, স্বামী ও পিতা হিসেবে পরিবারের প্রতি সমস্ত প্রতিজ্ঞা, মমতা ও উদ্বেগ সত্ত্বেও নিজের মিশন তাকে প্রায়ই সাধারণ পরিবারিক লোকের জীবনযাপন থেকে বিরত রেখেছে।
শেখ হাসিনা শিখেছেন, পিতা কীভাবে দুর্গত মানুষের সেবার মাধ্যমে শোষিত-বঞ্চিত মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠার সঙ্গে কন্যা দেখতে পান বাবা কীভাবে সাধারণ মানুষের-যাদের তিনি ‘আমার লোক’ বলে মনে করতেন; তাদের- ন্যায্য অধিকার অর্জনের জন্য গণ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু যখন তাদের জন্য স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিচয় বিনির্মাণ করেন; স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেন এবং সেই স্বাধীনতার স্বপ্ন বাক্সময় করে তোলেন এবং শেষ পর্যন্ত জাতি গঠনের সফল সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন; তখন তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেন শেখ হাসিনা।
‘আমি যখন নোটবুকের পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছিলাম এবং তার হাতের লেখা লাইনগুলোর ওপর হাত বুলাচ্ছিলাম, তখন আমার মনে হলো, বাবা আমাকে বলছেন: ‘ভয় পাস নে; আমি তোর সঙ্গে আছি; এগিয়ে যা এবং দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হ।’ ‘আমার মনে হলো আল্লাহ অলৌকিকভাবে আমাকে অদম্য হওয়ার জন্য বার্তা পাঠিয়েছেন,’ এক লেখায় লিখেছেন তিনি।
শুভ জন্মদিন, শেখ হাসিনা। জয়তু শেখ হাসিনা।