ভাষা আন্দোলন নিয়ে নেই পূর্ণাঙ্গ তথ্যনির্ভর চলচ্চিত্র
পৃথিবীতে একটি জাতিই আছে যারা নিজের ভাষায় কথা বলতে যুদ্ধ করেছেন। সে জাতির নাম বাঙালি। অর্জিত সেই ভাষার নাম বাংলা। খুব গর্ব করেই আমরা বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে এবং বলতে পারি আমাদের একটি ভাষা আছে।
যে ভাষার একটি ইতিহাস আছে। যে ইতিহাসের কথা বিশ্বজনীন। আমাদের ভাষা নিয়ে বিশেষ গান আছে। আমরা নির্দিষ্ট কোনো দিনে গাইতে পারি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি।’
যে ভাষার একটি রক্তিম বিশ্বাসযোগ্য এবং বিশ্বজনীন ইতিহাস আছে, সে ভাষা নিয়ে বাংলাদেশি জাতি হিসেবে আমাদের আছে দুঃখ, শোক আর সীমাহীন ক্লেদ। আছে কতিপয় একটি মহলের প্রতি ঘৃণা আর ফুঁসে ওঠা প্রখর প্রতিবাদ। এতদ্বসত্ত্বেও কিন্তু বাংলাভাষা বাঙালি জাতির কাছেই এখনও সার্বজনীন হয়ে ওঠেনি কিংবা উঠতে পারেনি।
এ ভাষার চর্চা এবং এর প্রতি ভালোবাসা ও মায়া শুধু ২৮ দিনে দেখানো হয়, তাও আবার ইংরেজি ভাষার মাস উল্লেখ করে! কষ্টটা এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। একদিকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হয়েছে আজ থেকে ৬৮ বছর আগে। অন্যদিকে বাংলাভাষা, সংস্কৃতির ধারক ও দর্পণ স্বরূপ বাংলাদেশি চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৭ সালে ২৭ মার্চ। যার বয়স ৬৩ বছর।
মায়ের ভাষায় মানুষ কথা বলে অর্থাৎ মনের ভাব প্রকাশ করে। অন্যদিকে মনের কথা ও চিত্র মানুষ দেখতে পায় চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এ দুই মাধ্যম যে অনেক খারাপ অবস্থানে আছে তা আমরা বুঝতে পারি দুটি বিষয়ে চর্চার জায়গা চিন্তা করলে।
৬৩ বছর বয়সী বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে ৬৮ বছর আগে পাওয়া বাংলাভাষা তথা ২১ নিয়ে নেই কোনো পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র তথা মানুষের মনের কথার ভাষার চিত্র। চলচ্চিত্রের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, কীর্তিমান নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার জহির রায়হান ১৯৭০ সালে নির্মিত তার জীবন থেকে নেয়া ছবিতে বাংলা ভাষা আন্দোলন তথা একুশের কিছু বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
মূলত এ ছবির একটি গানই আজকের বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। অন্যদিকে শহীদুল ইসলাম খোকন তার ‘বাঙলা’ ছবিতেও একুশের গল্প কিছুটা দেখানোর চেষ্টা করেছেন।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে মিশে আছে জহির রায়হানের নাম ও তার নির্মিত চলচ্চিত্র। ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের সম্ভাবনার দ্বারও উন্মোচন করেছেন জহির রায়হান। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই ঘোষণা আর পরবর্তীতে বাস্তবের মুখ দেখেনি। কিন্তু কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর অজানা। ২০১৯ সালে অভিনেতা ও নির্মাতা তৌকীর আহমেদ ‘ফাগুন হাওয়ায়’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে কিছুটা সাহসের পরিচয় দিলেও এটাকে পূর্ণাঙ্গ একুশের চলচ্চিত্র বলা যায় না। তবে তৌকীর যে এ সময়ে এসেও একুশের কথা মনে রেখেছেন এর জন্য হলেও সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
যে ভাষায় কথা বলছি, ভালোবাসা প্রকাশ করছি, প্রতিবাদ করছি, সে ভাষা নিয়ে কেন এত অপারগতা। কেন এত কৃপণতা? এমন প্রশ্ন ঢাকাই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার, নির্মাতা ও প্রযোজকদের কাছে। ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে প্রত্যাশিত চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পে।
এটা আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য চরম ব্যর্থতারই একটি অধ্যায়। রাষ্ট্র এবং বাংলা ভাষার প্রতি এক নির্মম অকৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ।
চলচ্চিত্রে একুশের ইতিহাস তথা বাংলাভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র না থাকার কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নন্দিত গীতিকার ও চলচ্চিত্রকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, ‘এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তবুও আজ বলতে হয়। সত্যিকার অর্থে আমরা এখন প্রাসঙ্গিক ভাবনায় ভুগছি অর্থাৎ এখন ভাষার মাস চলছে বলেই প্রতিবেদন লেখার জন্য আমাকে এ প্রশ্ন করা হয়েছে। কিন্তু অন্য ১১ মাস কি এমন প্রতিবেদন গণমাধ্যম করে?
এমন করে সব শ্রেণির মধ্যেই এখন বাণিজ্য বিরাজ করছে। একমাস ভাষার প্রতি ভালোবাসা জন্মায়, পরে আর মনে থাকে না। এ থেকে চলচ্চিত্রকাররাও বাইরে নয়। পাশাপাশি সঠিক ইতিহাস, তথ্য এবং চিত্রনাট্যের অভাব তো আছেই। সবকিছু মিলিয়ে আমরা এখনও সাংস্কৃতিক চর্চায় ভালো শিক্ষার্থী হতে পারিনি। এ বিষয়ে সরকারের ভূমিকা রাখতে হবে। তবেই একুশে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব হবে। এটাও তো সত্য, এখনও কেন পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়নি এ প্রশ্ন লজ্জাকর এবং কষ্টদায়ক।’
রাজশাহী বার্তা/admin