শাহ মখদুম এখনও রূপোশের নামে পরিচিত রাজশাহী

সময়: 1:03 pm - April 9, 2020 | | পঠিত হয়েছে: 532 বার

বহু পীর সাধকের পুণ্যভূমি রাজশাহী। এক সময় এ জনপদের মানুষ কু-সংস্কার আর অপসংস্কৃতি ও কু-প্রথার নিবিড় অন্ধকারের অতলে নিমজ্জিত ছিল। ওই সময় এই মহানগরে দেব-দেবীর নামে নরবলি দেওয়া হতো। মানুষে-মানুষে ছিল ভেদাভেদ।

তখন থেকে পীর সাধকের আগমন ঘটতে থাকে। সুদূর মধ্য প্রাচ্যসহ বিভিন্ন স্থান থেকে এদের আগমন ঘটে। তারা অবোধ মানুষের মধ্যে জ্ঞানের দ্বীপ্ত শিখা জ্বালানোর উদ্দেশে জীবনের সব সময়টুকু সময় ক্ষয় করে দেন। তাদের ডিঙ্গাতে হয় নানা প্রতিকূলতার দেয়াল। যুদ্ধ এমনকি প্রাণ বিসর্জনও দিতে হয় কাউকে কাউকে। এদেরই একজন জ্ঞান তাপোশ পদ্মার পাড়ে চীর শায়িত আছেন হজরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহঃ)।

ইসলাম ধর্মের দাওয়াত নিয়ে বাগদাদ থেকে আসা সেই সুফী সাধকের নামে এখনও পরিচিত হয় রাজশাহী।মাজার শরীফ। ছবি: বাংলানিউজরাজশাহী মহানগরের পদ্মার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা শাহ মখদুম রূপোশ (রহঃ) এর মাজার বা দরগা শরীফের কারণে ওই এলাকার নামই এখন দরগাপাড়া। দরগা মসজিদে প্রতিদিন ওয়াক্তিয়া নামাজে শতাধিক লোকের সমাগম ঘটে। সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে ওরোশ মোবারকসহ নানা ইসলামী আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এদিন দরগায় তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। আর পবিত্র রমজান মাস এলে যেন রোজাদারদের হাট বসে সেখানে। প্রতিদিন দুই শতাধিক রোজাদার ইফতার করানো হয় সেখানে।

আর পুরনো বিশ্বাসের জায়গা থেকে বিভিন্ন মনোবাসনা পূরণ বা শাহ মখদুম রূপোশ (রহঃ) এর মাধ্যমে আল্লাহ্’র কাছে অপার সন্তুষ্টি লাভের আশায় এখানে এসে ধর্মপ্রাণ নর-নারীরা নফল নামাজ আদায়সহ নানা ইবাদত বন্দেগী করে থাকেন। অনেকে আবার মাজার জিয়ারত করেই চলে যান। এছাড়া হিন্দু পরিবারের অনেক নারীদেরও প্রতি বৃহস্পতিবার মাজারে গিয়ে নিজ নিজ আস্থার জায়গা থেকে শিরনি বিতরণ করতে দেখা যায়।

বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন হিসেবে শাহ মখদুম (রহঃ) এর মাজার নির্মাণের সময়কাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ শ্যামপুর শিলালিপি ও একটি ফারসি শিলালিপির বরাত দিয়ে অনেকেই বলে থাকেন, সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে এটি নির্মিত। পরে আলী কুলী বেগ মাজারের আমূল সংস্কার করে বর্তমান গম্বুজটি নির্মাণ করেন।যতদূর জানা যায়, মুসলিম সওদাগর নদী পথে বিপদগ্রস্ত হয়ে হজরত শাহ মখদুমকে (রহঃ) স্মরণ করেন। তিনি সেই বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে এ মসজিদ নির্মাণ করেন। এর দৈর্ঘ ৪০ ফুট, প্রস্থ ১৬ ফুট। ভেতরের পরিসরের দৈর্ঘ ৩৪ ফুট সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি, প্রস্থ ১০ ফুট ১০ ইঞ্চি। তিনটি মেহরাবের মধ্যে মধ্যবর্তিটি অপক্ষোকৃত বড়।

উত্তর-দক্ষিণ দেয়ালে দু’টি করে চারটি তাক ও একটি করে দু’টি জানালা রয়েছে। পূর্ব দেয়ালে সমপরিমাপের তিনটি প্রবেশ পথ রয়েছে। এর কপাটগুলি পরে নির্মাণ করা হয়। ২০ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে পরপর দু’টি বারান্দা ও মিনার নির্মাণ করা হয় এখানে।

বিভিন্ন গ্রন্থে জানা যায় হজরত শাহ মখদুম (রহঃ) ছিলেন, বড় পীর আবদুল কাদের জ্বিলানী (রহঃ) এর পৌত্র এবং আজাল্লাহ শাহ’র দ্বিতীয় পুত্র। হজরত শাহ মখদুমের প্রকৃত নাম ছিল আব্দুল কুদ্দুছ জালালুদ্দীন। তিনি ৬১৫ হিজরি ২ রজব বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন।হজরত শাহ মখদুম রূপশ (রহঃ) চৌদ্দ শতকের একজন মুসলিম দরবেশ, যিনি বরেন্দ্র অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। ৬৮৫ হিজরিতে (১২৮৬ খ্রিস্টাব্দে) তিনি তার বড় ভাই সৈয়দ আহমদ ওরফে মীরন শাহকে নিয়ে বাগদাদ হতে এখানে আসেন।

রূপোশ তার উপাধি। আর শব্দটি ফারসি। ‘মখদুম’ অর্থ ধর্মীয় নেতা। আর রূপোশ অর্থ মুখ আবরণকারী। প্রচলিত কাহিনী অনুসারে, চিশতিয়া তরিকার একটি উপদলের দরবেশদের মতো তিনি তার মুখমণ্ডল একটুকরা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতেন এবং এজন্য তাকে রূপোশ বলা হতো।

৬৮৭ হিজরিতে (১২৮৮ খ্রিস্টাব্দে) শাহ মখদুম রূপশ বাঘা হতে রামপুর বোয়ালিয়ায় চলে আসেন। তিনি ওই এলাকার অত্যাচারী তান্ত্রিক রাজাকে পরাজিত ও হত্যা করে জনগণকে নিপীড়ন থেকে রক্ষা করেন। প্রতি বছর ১০ মহররম শাহ মখদুমের দরগায় ওরোশ অনুষ্ঠিত হয়। ওই দিন তাজিয়া বের করা হয় এবং লাঠি খেলা ও নকল তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধের মহড়া হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নাম এ দরবেশের নামে রাখা হয়েছে। এছাড়া তার নামেই রয়েছে রাজশাহীর ‘শাহ মখদুম বিমানবন্দর’।

তার রূপোশ উপাধি থেকে এই কথা বোঝা যায় যে, সাধারণ মানব বৈশিষ্ট ছাড়াও তার মধ্যে অসাধারণ ক্ষমতা লুকায়িত ছিল। আর হজরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহঃ) এর রাজশাহী আগমনের অন্তরালে পাওয়া বিস্তৃত ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১২৫৯ খ্রিস্টাব্দে মোঘল বীর হালাকু খান বাগদাদ আক্রোমণ করলে বড় পীর আবদুল কাদের জ্বিলানী (রহঃ) এর বংশধররা বাগদাদ থেকে কাবুল, কান্দাহার, পারস্য ও পাক ভারতের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

হজরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহঃ) এর পিতা আজাল্লা শাহসহ দিল্লিতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। উন্নত চরিত্র ও গুণাবলীর প্রতি মুগ্ধ হয়ে দিল্লির সম্রাট ফিরোজ শাহতার কাছে বায়েত হন। পিতার সহচার্যে তিন পুত্র সৈয়দ মুনির উদ্দীন আহমেদ (রহঃ), হজরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহঃ) ও সৈয়দ আহমদ তম্বরী (রহঃ) আধ্যাত্মিক সাধনায় সমৃদ্ধ লাভ করেন। হালাকু খানের মৃত্যুর পর শাহ আজাল্লা বাগদাদে ফিরে যান।

তার পুত্ররা ইসলামের বাণী প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে হেদায়েতের উদ্দেশে অনুচরবর্গসহ বাংলায় আগমন করেন। তখন রাজশাহী মহানগরের নাম ছিল মহাকাল গড়।

এখানে মহকাল দেবের বিখ্যাত মন্দিরে নরবলি দেওয়া হতো। তার স্মৃতি এখনও হজরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহঃ) দরগা শরীফে রক্ষিত আছে। মহাকাল গড়ে সেময় বহু রকমের দেব দেবতার প্রতিমূর্তি ও মঠ-মন্দিরে পূর্ণ ছিল।

হজরত শাহ মখদুম (রহঃ) রূপোশের সমাধি সৌধের প্রবেশ দ্বারে উপরিভাগে জনৈক আলীকুলী বেগ কর্তৃক রচিত ১০/৩৬ ইঞ্চি চার লাইন বিশিষ্ট একটি ফারসি ভাষায় লিখিত শিলা লিপি আছে।

এ লিপিতে শাহ দরবেশের মাজারের ওপর গম্বুজ নির্মাণের কথা উল্লেখ আছে। (১০৪৫ হিজরি বা ১৬৩৫ খ্রি:) শিলা লিপির সারমর্ম অনুযায়ী আলীকুলী বেগ দ্বাদশ মতাবলম্বি গোঁড়া শিয়া মুসলমান এবং পাস্যের শাহ আব্বাসের একজন ভক্ত ছিলেন।

তিনি এ দেশের নবাগত হিসেবে স্থায়ী মুসলমানদের সহানুভূতি লাভের আশায় হজরত শাহ মখদুম (রহঃ) এর সমাধি নির্মাণ করেছিলেন। আলীকুলী বেগ হয়ত শাহ মখদুম (রহঃ) এর সঠিক পরিচয় জানতেন না। তাই তিনি লিপিতে শাহ দরবেশ’ হিসেবে হজরত শাহ মখদুম (রহঃ) সম্বোধন করেছেন। অথচ ফারসি তায়েদাদে হজরত শাহ মখদুম রূপোশ নামের কথা উল্লেখ আছে। তাই আজও তিনি শাহ মখদুম ও তার মাজার শরীফ মখদুমের দরগা এবং হিন্দুদের কাছে মখদুম বাবা নামে পরিচিত।

হজরত শাহ মখদুম দরগা মসজিদের পেশ ইমাম মালানা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ধর্মীয় কুসংস্কারের জায়গা থেকে এখনও মাজারকে ঘিরে নানা কাজকর্ম হয়ে থাকে যা শরিয়ত সম্মত নয়। শিরক থেকে দূরে থাকার জন্য বিভিন্ন সময় তিনি জুম্মার বিশাল জামায়াতে বয়ান করে মানুষকে সচেতন করে থাকেন। এর পরও এক শ্রেণির মানুষ জায়েজ নয় এমন কাজ করে থাকেন। দরগা স্টেট মসজিদ ও মাজার পরিচালনা করেন। মসজিদে পাঁচ হাজার মুসল্লির ধারণ ক্ষমতা রয়েছে বলে জানান তিনি।

রাজশাহী বার্তা/admin

এই বিভাগের আরও খবর