চাঁপাইনবাবগঞ্জে দুগ্ধ খামারিরা দুধের চাহিদা না থাকায় বিপাকে
‘দুধ দুহ্যা এখুন পদ্মা লোদীতে (নদী) ফেলছি। না দুহিলে তো আবার গরুর বাট টাটাইবে (ব্যথা করবে)। আর যেদিন বাড়ি যাই, সেদিন গাঁয়ের লোককে বিনা পায়সাতেই দুধ বিলাই ক্ষির খাওয়ার ল্যাগা। কম দামে দুধ কিনতে চাহে গাঁয়র লোক। কিন্তু রাগ কইর্যা বেচি না। ক্যামুন কইরা যে আর দিনগালা যে পার করব জি ভাই বুইঝা পাছি না।’ কথাগুলো বলছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বগলাউড়ি গ্রামের সাহেব আলী। একপাল গরু নিয়ে তিনি এখন অবস্থান করছেন পদ্মা নদীর চরে। মুঠোফোনে যোগাযোগ করতেই করোনাকালে নিদারুণ কষ্টে থাকার গল্প শোনালেন তিনি।
শুধু সাহেব আলী নয়, এই করোনাকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শত শত রাখাল দলের অবস্থা এমন করুণ। ন্যায্যমূল্যে দুধ বিক্রি করতে না পেরে তাদের কষ্টের সীমা নেই।
এসব রাখাল পদ্মা নদীর ধু ধু চর ও বরেন্দ্র ভূমির মাঠে মাঠে দল বেঁধে গরু চরান। বেদুইনের মতো জীবন তাঁদের। কদিন এখানে তো, কদিন সেখানে আস্তানা গাড়েন। মোটা পলিথিন বা ত্রিপলে ছাউনির সেসব আস্তানা। কখনো রাত কাটে ছাতার তলে। গরু থাকে খোলা আকাশের নিচে।
একেক পালে গরু থাকে দেড়’শ থেকে চার’শ পর্যন্ত। পালের সঙ্গে থাকে পাঁচ থেকে দশজনের রাখাল দল। পালের গরুর প্রায় অর্ধেকের মালিক রাখালেরা। চরানোর বিনিময়ে অন্য মালিকের গরুর দুধ পান কেবল তাঁরা। নতুন জন্ম নেওয়া বাছুরের ওপর কোনো ভাগ থাকে না তাঁদের। কারও কারও আবার কেবল নিজের গরুই থাকে।
খুব ভোরে গরুর পাল নিয়ে বের হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় রাখালদের দিন। ফিরে আসেন সকাল আট-নয়টার মধ্যে। ভাত দিয়ে নাশতা সেরে গরুর দুধ দোয়ানোর পর ক্ষুদ্র দুধ ব্যবসায়ী বা গোয়ালার কাছে দুধ বিক্রি। এরপর দুপুর ১২টা থেকে বেলা ১টার মধ্যেই সকালে রাঁধা ভাত খেয়েই গরুর পাল নিয়ে বেরিয়ে পড়া। ফেরা হয় সন্ধ্যর সময়। কিন্তু এই করোনা পরিস্থিতি তাঁদের সবকিছু উল্টোপাল্টা করে দিয়েছে। নিদারুণ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন তাঁরা। এই ঘাটতি মেটাতে অনেককে বিক্রি করতে হবে পালের গরু।
গত বৃহস্পতিবার বরেন্দ্র এলাকার চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম ইউপির লাগোয়া রাজশাহীর গোদাগাড়ীর দোয়াতপোখরা এলাকায় দেখা হয় একটি গরুর পালের গোলাম মাওলা (৬২), রজবুল হক (৬০) ও রবিউল হক (৩৫) নামের কয়েকজন রাখালের সঙ্গে। তাঁদের মধ্য নেতৃস্থানীয় গোলাম মাওলা বলেন, ‘বাপের হাত ধইরা ছুটু বেলা থ্যাকাই রাখালি কইর্যা আসছি। কিন্তু এমুন আকালে কখুনো পরিনি। কুণ্ঠে থ্যাকা কী আইলোরে ভাই এগলা। এই বিপদ থ্যাকা কে হামরাকে (আমাদের) বাঁচাইবে?’
গোলাম মাওলা বলেন, এই পালে ছয়জনের গরু ও বাছুর মিলিয়ে আছে প্রায় ২৫০টি। এর মধ্যে দুধ দেয় ৮০টি। করোন-সংকটের আগে দুধ পাওয়া যেত প্রায় ৩০০ কেজির মতো। দুধ বিক্রি না হওয়ায় এখন দুধ দোয়ানো হয় মাত্র ৩০ থেকে ৪০ কেজির মতো। আগে যে ক্ষুদ্র দুধ ব্যবসায়ীরা এসে দুধ নিয়ে যেতেন, তাঁরা আসেন না। কেন না তাঁদেরও খাবার হোটেল, রেস্তোরাঁ, দই-মিষ্টির দোকান ও ছানা তৈরির কারখানা বন্ধ। রাখালদেরই দু-একজন আশপাশের গ্রামে দুধ বিক্রি করে আসেন ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি দরে। ওই টাকায় তরিতরকারি কেনা হয় এবং কিছু রাখা হয় হাত খরচের জন্য। আর চাল নিয়ে আসতে হচ্ছে বাড়ি থেকে।
রাখালেরা জানান, গরুর দুধ না দোয়ানোর জন্য বাছুর খেয়ে নিচ্ছে বেশি বেশি দুধ। এতে বাছুরের পাতলা পায়খানা হচ্ছে। তখন আবার ওষুধ কিনে খাওয়াতে হচ্ছে। এদিকে বৃষ্টিবাদলের অভাবে মাঠে বেশি ঘাস জন্মেনি। গরুও পেট পুরে খেতে পারছে না।
পাশের একটি পালের মো. আলম (৬০) জানান, তাঁর পালের গরু ঠিকমতো খেতে না পাওয়ায় একটি বয়স্ক গরু আর উঠে দাঁড়াতে পারছিল না। তখন ভটভটিতে তুলে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দানা জাতীয় খাবার খাইয়ে গরুটিকে তাজা করা হবে। তাঁদের পালে ৩৫০টি গরু-বাছুর। এর মধ্যে দুধ দেয় ১৩০ থেকে ১৩৫টি। আগে দুধ পাওয়া যেত পাঁচ মণ। এখন এক-দেড় মণ। বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুধ বিক্রি করতে হয় ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার রানীহাটি ইউপির বহরম গ্রামের মো. আলম বলেন, গ্রামে তাঁরসহ আরও বেশ কয়েক মাওয়া (দুধ জ্বাল দিয়ে তৈরি ক্ষীর) তৈরির কারখানা আছে। সবগুলো এখন বন্ধ। কারখানগুলোতে বরেন্দ্র এলাকা ও পদ্মার চর এলাকার গরুর পালগুলো থেকে দুধ আসত। তাঁরা এখন দুধ বিক্রি করতে পারছেন না। চর এলাকার এমন প্রায় ৪০টি এবং বরেন্দ্র এলাকায় বহু গরুর পালের খারাপ অবস্থার কথা তিনি জানেন। গরু বিক্রি করে তাদের ঘাটতি পূরণ করতে হবে।
বহরম গ্রামের আরেক রাখাল মো. বাবু (৪০) বলেন, তাঁর ও তাঁর চার চাচাতো ভাইয়ের পালের গরুর সংখ্যা ২৫০। প্রায় ১৫ থেকে ২০ দিন থেকে গরু দুধ দোয়ানো বন্ধ। বাছুরই খাচ্ছে দুধ। বেশি বেশি দুধ খেয়ে বাছুরগুলোর পাতলা পায়খানা হচ্ছে। ওষুধ কিনে খাওয়াতে তাঁর নিজেরই খরচ হয়েছে ছয় হাজার টাকা। গরুর খুরা ও বাদলা রোগ দেখা দিচ্ছে। কিন্তু ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে না।
প্রাণিসম্পদ বিভাগ চাঁপাইনবাবগঞ্জের গরু-ছাগলকে ভ্যাকসিন দেওয়া কার্যক্রমের দায়িত্বে নিয়োজিত ইসরাফবল হক বলেন, বিভিন্ন এলাকায় ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য কেন্দ্র নির্ধারণ করে মাইকে প্রচার করা হতো গরু-ছাগল নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু লোকসমাগমের আশঙ্কা থেকে সম্প্রতি এ কার্যক্রম বন্ধ আছে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কার এ সময়ে গরুর পালের রাখালদের দুঃসময় চলছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান এ ব্যাপারে বলেন, সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও সদর, শিবগঞ্জ, ভোলাহাট ও গোমস্তাপুর উপজেলায় বহু গরুর পাল আছে। এসব পালের রাখালেরা খুবই কষ্ট করে চর, বরেন্দ্র এলাকা ও বিল এলাকায় গরু চরান। প্রায় বেদুইনের মতো জীবন তাঁদের। কম খরচে গরু-বাছুর লালন-পালন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। জেলায় দুধের একটা বড় অংশ তাঁদের কাছ থেকেই আসে। এই সময়ে দই, মিষ্টি, ছানা, মাওয়া উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁদের দুধ বিক্রিও বন্ধ হয়ে গেছে প্রায়। খুবই সংকটে আছেন তাঁরা। এ ছাড়া সংকটে আছেন গ্রামগঞ্জের গাভি পালনকারী ও খামারিরাও।
রাজশাহী বার্তা/admin