পুরাকীর্তি দেখতে গৌড়ের রাজধানীতে একদিন

সময়: 9:57 pm - February 20, 2020 | | পঠিত হয়েছে: 1182 বার

পরিকল্পনা ছিল সাপ্তাহিক ছুটির বাইরে কোনো ছুটি মিললেই ছুটে যাব উত্তরের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে। দেখতে দেখতে আশুরার ছুটিও চলে এলো। কিন্তু মিলল না ভ্রমণসঙ্গী। কেউ কেউ পুরাকীর্তি দেখতে ঢাকা থেকে এত দূর যেতে ইচ্ছুক নন, কারো মিলছিল না সময়। তাই অফিস শেষে একাই রওনা হলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জের পথে। বলে রাখি, এই জেলা প্রাচীন আমলে বাংলার জনপদ ও ভৌগোলিক অঞ্চল ‘গৌড়’র অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রাচীন গৌড় অঞ্চলের রাজধানী ছিল (যা লক্ষ্মণাবতী নামেও পরিচিত ছিল) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা ও বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ অংশজুড়ে। একসময় পুরো বাংলার রাজধানীও হয়ে ওঠে গৌড় নগর (যা একসময় জান্নাতাবাদ নামেও পরিচিত ছিল, এমনকি কিছু সময় পাণ্ডুনগরও এর অংশ ছিল)। ইতিহাসের নানা বাঁকে এই অঞ্চলের রাজধানী ও শাসক বদলায়। এসব ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে এখনো পুরোনো অনেক নিদর্শন টিকে আছে।

রাতে মতিঝিল থেকে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছতে বেশ দেরি হলো। প্রখ্যাত পরিবহনগুলোর কোনো বাস পেলাম না। অগত্যা কিছুটা ভোগান্তি হবে জেনেও লোকাল এক বাসে ওঠা। বেশ দেরি করেই রাজশাহী পৌঁছাল বাসটি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাওয়ার ভাড়া নিলেও কন্ডাক্টর বলছে, ‘এ পর্যন্তই শেষ! বাস আর যাবে না।’ কথা কাটাকাটির পর অবশেষে উঠিয়ে দিলো চাঁপাইগামী বাসে। পৌঁছতে বেলা ১১টা। দিনের বাকি সময়ে কীভাবে পুরাকীর্তিগুলো ঘুরে দেখব এটাই শঙ্কা। তবে পুরাকীর্তিগুলোর অবস্থান একই রুটে ও কাছাকাছি হওয়ায় অল্প সময়ে ঘুরে দেখতে সমস্যা হয়নি। রুট বিষয়ক তথ্য ও যাবতীয় সহযোগিতায় ছিলেন তৎকালীন পত্রিকার সহকর্মী ও জেলা প্রতিনিধি আব্দুর রব নাহিদ ভাই। জেলা সদর থেকে অটোরিকশাযোগে শিবগঞ্জ। এরপর স্থানীয় জিয়া ভাইকে সঙ্গে নিয়ে কানসাট হয়ে সোজা ছোট সোনামসজিদ স্থলবন্দর। সীমান্ত সংক্রান্ত আইনি জটিলতা ও নিরাপত্তার কারণে কোতোয়ালী দরোজাটা ছুঁয়ে দেখা হলো না। তবে দুই দেশের সীমানা পার্থক্যকারী ঐতিহাসিক স্থাপনার সামনে বেশ কয়েকটি ছবি তোলার সৌভাগ্য হলো বিজিবির ভাইদের কল্যাণে।

এরপর ভ্যান ভাড়া করে খনিয়াদীঘি ও চামচিকা মসজিদ। চারদিকে আম বাগান পরিবেষ্টিত দীঘির সৌন্দর্য যেন বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে এর বিশালতা। পাখির কলকাকলীতে মুখর এলাকাটিতে অবস্থিত পোড়ামাটির ইটের তৈরি কারুকার্যখচিত চামচিকা মসজিদ নজর কাড়বে যে কারো। নিরিবিলি-শান্ত পরিবেশের অঞ্চলটি ঘিরে বনভোজনের ব্যবস্থাও রয়েছে। গড়ে উঠেছে টং দোকান ও রয়েছে বসার বেশ কয়েকটি জায়গা। বৈশাখ-জ্যেষ্ঠে গাছে ঝুলে থাকা বড় বড় আমগুলোও কম আকর্ষণীয় নয়। চামচিকা মসজিদে জোহরের নামাজের পর বালিয়াদীঘির পাশে গেলাম। বল্লাল সেনের আমলে নির্মিত দীঘিটির বিশালত্ব নজর কাড়ল। এ অঞ্চলে অবশ্য খনন করা দীঘি রয়েছে অনেকগুলো। সবই বিশালাকার ও রাজা-বাদশাহদের সময়কালে নির্মিত।

প্রধান সড়কের অদূরেই তাহখানা। ফার্সি শব্দ ‘তাহখানা’ অর্থ ‘ঠান্ডা ভবন বা প্রাসাদ’। বিশালাকার পুকুরের পাশে অবস্থিত তাহখানাটি দেখে নামের স্বার্থকতা অনুমান করতে দেরি হলো না। আরও নিশ্চিত হলাম তাহখানার দক্ষিণ পাশের ভবনের নিচতলায় গিয়ে। মাটির নিচে অবস্থিত এ স্থানটি তুলনামূলক বেশ গরম হওয়ার কথা। সুড়ঙ্গ দিয়ে নামতে নামতে বিষয়টি অনুভবও করছিলাম। কিন্তু ভেতরের কক্ষগুলোতে গিয়ে মুখোমুখি হলাম ভিন্ন পরিবেশের। পুকুরের পানির সঙ্গে প্রায় লাগোয়া কক্ষগুলোতে রয়েছে ছোট ছোট ছিদ্রের মতো অনেকগুলো ফাঁক। দখিনা বাতাস পুকুরের পানিতে ডিগবাজি খেয়ে ফাঁক গলে ভেতরে ঢোকে। সঙ্গে সঙ্গেই ঠান্ডা কক্ষ! এয়ার কন্ডিশনারের কোনো প্রয়োজনই নেই। এখানে গেলে স্পষ্ট অনুধাবন করা যায় তাহখানা নামের স্বার্থকতা।

তাহখানার ভবনগুলো দেখে বোঝা যায় তা মুঘল আমলের কীর্তি। পাশাপাশি শাহ সৈয়দ নেয়ামতউল্লাহ নামে (রহ.) নামে এক ইসলাম ধর্ম প্রচারকের কবর ও মাজার থাকায় ইতিহাসের অধ্যায়টি আরও স্পষ্ট হয়। সেখানে এ সংক্রান্ত ঐতিহাসিক তথ্য লিপিবদ্ধ আছে। পর্যটকরা তা একনজরে পড়ে নিলে ভালো হয়। কোথায় ভ্রমণ করছি সে বিষয়ে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া! মাজারের চারপাশে অবস্থিত ফুলের বাগান ঢাকার লালবাগ কেল্লার কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। তাহখানাটিতে তিন গম্বুজবিশিষ্ট একটি মসজিদও রয়েছে।

প্রধান সড়কের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিবারই এখানকার সবচেয়ে নামকরা স্থাপনা ছোট সোনামসজিদ চোখে পড়ে। কিন্তু আগেই নিয়ত করে রেখেছি এখানে আসরের নামাজ পড়ব। হোটেল শেরাটনের পাশে অবস্থিত হোটেল সোনারগাঁওয়ে দেরি করে দুপুরের ঠান্ডা খাবার খেলাম। এরপর আসরের নামাজ পড়লাম ছোট সোনামসজিদে। প্রধান সড়কের পাশে অবস্থিত হওয়ায় মালবাহী ট্রাক ও অন্যান্য ভারী যান সতর্কতার সঙ্গে ধীরে চলার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? চালকদের বেপরোয়া চালনায় সুলতানি আমলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এ স্থাপত্যকর্মটি নিয়মিত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঝুঁকিতে রয়েছে আরও বড় ধরনের ক্ষতির। ১৫ গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটিতে নামাজ পড়ার সময় বিষয়টি হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। মালবাহী ট্রাক যাচ্ছে আর কেঁপে উঠছে মসজিদ প্রাঙ্গণ ও ভবন। তারপরও শুধু সতর্কবার্তা দিয়েই নির্বিকার প্রশাসন! বর্তমানে মসজিদ প্রাঙ্গণের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ও মুক্তিযোদ্ধা মেজর নাজমুল হকের কবর রয়েছে।

বিকেলে শুরু হলো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। বৃষ্টির মাঝেই ভ্যানে চড়ে ছুটলাম প্রায় ৫০০ বছর আগেকার দারসবাড়ি মসজিদ ও মাদরাসার উদ্দেশে। ভিজলেও কিছু করার নেই। সময় কম, রাতেই রওনা হব ঢাকার পথে। মাদরাসাটি বেশ বড়। তবে এর বেশিরভাগ অংশই এখন মাটির নিচে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া ভবনটির কক্ষ ও দেয়ালের উপর দিয়ে হাঁটলাম। বেশ বড় বড় ঘাস জন্মেছে। মাঝে চলছে ক্রিকেট খেলা। কেউবা চড়াচ্ছেন গরু-ছাগল। চারপাশে আমবাগানে ঘেরা এলাকাটি বেশ শান্ত ও সুন্দর। এলাকাটি ঘুরে বেশ ভালো লাগল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মাঝেই পুকুর ও গাছে ঘেরা দারসবাড়ি মসজিদে গিয়ে উঠলাম। ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু মাঝে অনেক কিছুই নেই। নেই ছাদও। তাই মসজিদ ভবনটি বেশ খোলামেলা। নেই নামাজ পড়ার মত অবস্থা। উঁচু স্থানে অবস্থিত মসজিদটির স্থাপনা মুগ্ধ করবে যে কাউকে। বারান্দার খিলানে ৭টি প্রস্তরস্তম্ভের উপরের ৬টি ক্ষুদ্রাকৃতি গম্বুজের চিহ্ন রয়েছে। উপরে ৯টি গম্বুজের চিহ্নাবশেষ অবশিষ্ট রয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণে ৩টি করে জানালা ছিল। পশ্চিম দেয়ালে পাশাপাশি ৩টি করে ৯টি কারুকার্য খচিত মেহরাব এখনো রয়েছে। সুলতানি আমলের এই স্থাপত্যকর্ম মনে করিয়ে দেবে মিশর ও সিরিয়ায় অবস্থিত প্রাচীন মসজিদগুলোর কথা। ভালো লাগার পাশাপাশি থাকবে নতুন ধরনের এক স্থাপত্যকর্ম দেখার মুগ্ধতা। সত্যি কথা বলতে কী, এই মসজিদ ও এর চারপাশের পরিবেশই আমাকে মুগ্ধ করেছে সবচেয়ে বেশি।

বেলা পড়ে এলো। এবার ফিরতে হবে। কানসাটের রাস্তার দুই পাশে অবস্থিত দেশের সবচেয়ে বড় আমের বাজার ও আমবাগান। যাওয়া-আসার পথে এগুলো মুগ্ধ করবে যে কাউকে। স্থানীয়রা জানালেন, আমের মৌসুমে বাগান ও বাজার দেখতে আসেন অনেক পর্যটক। ঠিকই তো, অজস্র বাগানে হাজার হাজার গাছগুলোকে খালি দেখতে কি ভালো লাগে? আমবাগান ও পুরাকীর্তির বিষয়টি মাথায় রেখে সরকারও পর্যটনের দিকে নজর দিয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে মোটেল। কিন্তু ২০১৩ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীকে সাজা এবং চাঁদে দেখার গুজবকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতায় উদ্বোধনের আগেই বন্ধ হয়ে যায় সেটি। তাই সেখানে থাকার সুযোগ হয়নি। রাস্তা-ঘাটের ভাঙাচোরা অবস্থার কারণে অটোরিকশা ভ্রমণটাও তেমন আরামদায়ক হলো না। কিন্তু নতুন স্থান ভ্রমণের আনন্দে খারাপ লাগাটা বেশিক্ষণ থাকল না। জেলা সদরে ফিরতেই মিলিয়ে গেল। এরপর ঐতিহ্যবাহী কালাইয়ের রুটি খেয়ে ধরলাম ঢাকার বাস। ঢাকা থেকে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পুরাকীর্তিগুলো কাছাকাছি হওয়ায় হয়ত আবারো যাওয়া হবে প্রাচীন গৌড়ের এই রাজধানীতে। ফিরে যাব কয়েকশ বছর আগের ইতিহাসের সান্নিধ্যে।

রাজশাহী বার্তা/admin

এই বিভাগের আরও খবর